নতুন কমিটির দাবিতে দ্বিধাবিভক্ত ছাত্রদল

কেন্দ্রীয় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এখন আরো বেশি দ্বিধাবিভক্ত এবং অগোছাল। বছরের পর বছর হালনাগাদ হয়নি বেশির ভাগ জেলা ও সাংগঠনিক ইউনিটগুলোর কমিটি। ২০১৪ সালে ঘোষিত ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ৭৩৪ সদস্যের কেন্দ্রীয় ছাত্রদল এখন বহু উপদলে বিভক্ত। সভাপতি রাজীব আহসান ও সেক্রেটারি আকরামুল হাসানকে মানছেন না কেউ। শীর্ষ এ দুই নেতার প্রতি অনাস্থাও জানিয়েছেন বহু নেতা। ছাত্রদলের যেকোনো কর্মসূচি এখন পালিত হয় পদপ্রত্যাশী ডজনখানেক নেতার নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নভাবে। এসব মিছিলে উপস্থিতিও বিব্রতকর। কোনো মিছিলে ১০, কোনো মিছিলে ১৫ কিংবা ২০-২৫ জন। প্রতিটি কর্মসূচির দিন মিডিয়াতে যে প্রেস রিলিজ পাঠানো হয়, তার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল থাকে না। এমন অবস্থার মধ্যেই বর্তমান কমিটিই সংগঠনের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে আগামী সোমবার। তবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে ছাত্রদলের বহু নেতাকর্মী মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, আজকে ৩৯ বছরে এসে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে পারস্পরিক আস্থাহীনতায় ভুগছে ছাত্রদল। নতুন কমিটি না হওয়ায় সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনাও বিরাজ করছে। দিন যতই যাচ্ছে ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কেউ কেউ সামাজিক গণমাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারও চালাচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুকে কমিটির দাবিতে নেতাকর্মীরা নানা মন্তব্য পোস্ট করছেন। তবে নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে তৎপর ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা রয়েছে বড় একটি অংশের। বর্তমান কমিটি ঐতিহ্য অনুযায়ী মাজারে ফুল পর্যন্ত দেয়নি, শপথও নেয়নি। কোনো সাংগঠনিক টিম করেনি, সবকিছু সভাপতি ও সেক্রেটারি একা করছেন। আজ পর্যন্ত এ কমিটি একটা সাধারণ সভাও করতে পারেনি। সভাপতি-সেক্রেটারি এককভাবে সব কাজ করায় বাকি নেতারা নিজের পদের পরিচয় দেয়া ছাড়া তাদের সাংগঠনিক আর কোনো কাজ নেই।
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি : ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। গত বছরের ১ জানুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখেও নতুন কমিটির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন ছাত্রনেতারা। বর্তমান কমিটির বেশির ভাগ নেতার ছাত্রত্ব না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এ কমিটি গঠনের পর থেকেই তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। বর্তমান কমিটির শীর্ষ তিনজন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে পদ পেয়েছেন। এ কারণেই ছাত্রদল নেতারা সর্বস্তরে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন। এ লক্ষ্যে ছাত্রদলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী দলীয় কার্যালয়ে একত্র হয়ে বর্তমান কমিটির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে অবিলম্বে নতুন কমিটি গঠনের দাবিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন।
ছাত্রদলের সাংগঠনিক চিত্র : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর পুরনো এবং নতুন করে ঘোষিত ইউনিটসহ ৪১টি জেলা সমমর্যাদার কমিটি ঘোষণা করেছে। ঢাকার পুরনো কিছু থানা মর্যাদার ইউনিটকে নতুন করে জেলার মর্যাদা দিয়ে কমিটি করা হয় যেমন- ঢাকা কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, বাংলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ ও কবি নজরুল কলেজ। তবে এমন কিছু জেলা শাখা রয়েছে যেগুলোর কমিটি হয়নি গড়ে ৮ থেকে ১৯ বছর ধরে। কমিটি হালনাগাদ ও পূর্ণাঙ্গ না হওয়া ইউনিটগুলোর মধ্যে- মেহেরপুর জেলা, গাজীপুর, কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, ঢাকা মেডিক্যাল, বগুড়া জেলা উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র ১৩টি, ১০টা মহানগরের মধ্যে মাত্র চারটি এবং ১২টি ইউনিটকে নতুন জেলা সমমর্যদা ঘোষণা করে কমিটি দেয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগই অগুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বলে কেউ কেউ বলছেন। আরো জানা যায়, ছাত্রদলের ইউনিয়ন কমিটি হয় না গড়ে প্রায় ১২ বছর ধরে। উপজেলা ও থানা কমিটিগুলোও হালনাগাদ তথা পূর্ণাঙ্গ হয় না গড়ে প্রায় ৯-১০ বছর ধরে। সরকারি কলেজ শাখাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও একই দশা।
কমিটির দাবিতে অনশন : গত বছর ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগেই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সব শাখার কমিটি গঠনের দাবিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর অনশন করেন সংগঠনটির সহতথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক মামুন খান। পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আশ্বাসে অনশন ভাঙেন তিনি।
শীর্ষ পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ : সংগঠন সূত্রে জানা যায়, আগামীতে ছাত্রদলের শীর্ষপদে থাকতে আগ্রহী অনেকেই। সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এসব নেতার মধ্যে রয়েছেন নাজমুল হাসান, আলমগীর হোসেন সোহান, আসাদুজ্জামান আসাদ, আবু আতিক আল হাসান মিন্টু, ইখতিয়ার কবির, মামুন বিল্লাহ, জহিরুল ইসলাম বিপ্লব, মফিজুর রহমান আশিক অন্যতম। ইতোমধ্যে নাজমুল হাসান, মফিজুর রহমান আশিকসহ কয়েক নেতা জেলও খেটেছেন। এর বাইরেও শীর্ষ পদের জন্য চেষ্টা করছেন বায়েজিদ আরেফিন, কাজী মোক্তার হোসেন, রাশিদুল ইসলাম রিপন, মিনহাজুল ইসলাম ভুইয়া প্রমুখ। ছাত্রদলের কয়েকজন সহসভাপতি আলাপকালে বলেন, যেহেতু বর্তমান কমিটির মেয়াদ পার হয়েছে অনেক আগে। তাই সংগঠনের সবার মধ্যেই নতুন কমিটির দাবি থাকা স্বাভাবিক। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আগেই যেন ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হয়। সে জন্য তারা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটিকে উপযুক্ত মনে করছেন। যারা বর্তমান কমিটি থেকে বাদ পড়বেন তাদের যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান দিতে মত দেন তারা। তবে ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে যাদের দায়িত্ব দেয়া হবে, তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কারণ বর্তমান কমিটি স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যার কারণে বিগত সময়ে বর্তমান কমিটি সারা দেশে কোনো কার্যকর কর্মসূচি পালন করতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, ছাত্রদলের দ্বারাই ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ এবং আদর্শবাদী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ছাত্রদলের নেতৃত্বেই আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হয়েছিল। ছাত্রদলের আগামী নেতৃত্বের জন্য বিএনপির হাইকমান্ড তৎপর রয়েছে। তাদের নির্দেশ মতো সম্ভাব্য ছাত্রনেতাদের তালিকা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াধীন। তবে কমিটি ঘোষণার ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত দিতে পারেননি তারা। জানা গেছে, অতীতের মতো পকেট কমিটি করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের লোক নিয়ে আসার মতো পরিস্থিতি যেন না হয়, সে জন্য এবারের কমিটি সরাসরি বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তদারকি করছেন। হঠাৎ করেই সুবিধাজনক সময়ে চলে আসতে পারে ছাত্রদলের নতুন কমিটি। নতুন কমিটি হবে, এমন প্রত্যাশায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া এবং আসার পথে তার গাড়িবহরে শোডাউন করছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ছাত্রদলের সাবেক দুইজন সভাপতি জানান, বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের প্রবেশদ্বার হলো ছাত্রদল। আজকে নানা কারণে সংগঠনের অবস্থা নাজুক। এ পরিস্থিতি উত্তরণে দ্রুত নতুন কমিটি দেয়া দরকার।

No comments

Powered by Blogger.