এক বছরেও শুরু হয়নি বিচারকাজ

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের (গাইবান্ধা-১) সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যার এক বছর আজ ৩১ ডিসেম্বর রোববার। এত দিনেও এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি চন্দন সরকারকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। শুরু হয়নি মামলাটির বিচার কার্যক্রম। তবে গত শুক্রবার সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হত্যা মামলায় আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাতজন কারাগারে আছেন। আসামি চন্দন সরকারকে সম্প্রতি ভারতে আটক করা হয়েছে। তাঁকে দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এদিকে সাংসদের পরিবার-পরিজন, দলীয় নেতা-কর্মী ও এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক এখনো কাটছে না। এ আসনে এক বছরের ব্যবধানে দুই সাংসদের মৃত্যু, সাবেক এক সাংসদের কারাভোগ ও আরেক সাবেক সাংসদ পলাতক থাকায় এ আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। জানতে চাইলে সাংসদ মনজুরুল ইসলামের স্ত্রী খুরশিদ জাহান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন স্বামীর হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি। ওদের (আসামি) এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে না পারে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এখনো পরিবার ও আমার মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। রাস্তায় বের হলে, কোথাও গেলে ভয় লাগে। নিরাপত্তা সমস্যাও বোধ করছি।’ ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সাংসদ মনজুরুল ইসলাম নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় তাঁর ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। শুরুতে জামায়াত-শিবিরের ওপর এর দায় চাপানো হয়। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। পরে ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া একটি ম্যাগজিনের সূত্র ধরে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করার কথা জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ কাদের খানকে।
তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গ্রামের বাড়ি থেকে একটি অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর সহযোগীদের। তাঁরা হলেন কাদের খানের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শাহিন মিয়া, মেহেদী হাসান, রানা মিয়া, গাড়িচালক আবদুল হান্নান, তাঁর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জোহা মিয়া ও সুবল চন্দ্র। বর্তমানে চন্দন সরকার ছাড়া সব আসামি কারাগারে রয়েছেন। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় কাদের খানের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করে পুলিশ। বর্তমানে অস্ত্র মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। কিন্তু হত্যা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) শফিকুল ইসলাম শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মামলার এক আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়নি। আগামী ৮ জানুয়ারি মামলাটি গাইবান্ধা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর হবে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চাইলে ওই আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া অবস্থায়ও মামলার বিচার শুরু করা যেত। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে এখনো বিচার শুরু হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বশূন্য উপজেলা কমিটি: সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন সাংসদ মনজুরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাংসদ গোলাম মোস্তফা। তাঁরা মারা যাওয়ার পর এখনো এ দুইপদে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এ কারণে উপজেলা কমিটি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। এখানে দলটির অঙ্গ সংগঠনগুলোরও একই অবস্থা। এ ছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও পৌর মেয়র আবদুল্যাহ-আল-মামুন বলেন, দলে নেতৃত্ব না থাকায় বর্তমানে দলের গতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। লোকমুখে আলোচনা হচ্ছে, এখানে যেই আওয়ামী লীগের সাংসদ হন, সেই মারা যান। এ নিয়ে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী ও সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠিত।
নীরব সাংসদের বাড়ি
সাংসদের সাহাবাজ গ্রামের বাড়িতে এখন সুনসান নীরবতা। আগের মতো দলীয় নেতা-কর্মীদের আড্ডা নেই। নেই সমর্থকদের সমাগম। গত শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, সাংসদের দোতলা বাড়িতে তেমন লোকজন নেই। নিচের অতিথিকক্ষ (যে কক্ষে সাংসদকে গুলি করা হয়) বন্ধ। উঠোনে সাংসদের কবর। এর পাশে গাবগাছের নিচে দাঁড়িয়ে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক। পুরো বাড়ি যেন খা-খা করছে। সাংসদ মনজুরুল স্মরণে আজ রোববার দিনব্যাপী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কালোব্যাজ ধারণ, মসজিদে দোয়া, গ্রামের বাড়িতে মিলাদ মাহফিল ও শোকসভা। পরিবারের লোকজন, দলীয় নেতা-কর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ এ আয়োজন করেছে। এতে কেন্দ্রীয়, জেলা ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের উপস্থিত থাকার কথা।
এলাকায় আতঙ্ক
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী বলেন, সাংসদ মনজুরুল ইসলাম নিহতের কারণে আসনটি শূন্য হওয়ায় গত বছরের ২২ মার্চ এখানে উপনির্বাচন হয়। এতে আওয়ামী লীগের টিকিটে সাংসদ হন গোলাম মোস্তফা। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ১৯ ডিসেম্বর মারা যান। এর আগে ২২ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে আরেক সাবেক সাংসদ জামায়াত নেতা আবদুল আজিজসহ ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড দেন উচ্চ আদালত। তাঁদের মধ্যে আবদুল আজিজসহ পাঁচজন পলাতক। এসব কারণে এলাকায় এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে থার্টি ফাস্ট নাইটে (৩১ ডিসেম্বর) সারা দেশের মানুষ আনন্দ করবে, কিন্তু সেদিন আমরা সাংসদের শোক দিবস পালন করব। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিরা নানা ষড়যন্ত্র করতে পারে। এসব কারণে সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’ এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার (এসপি) মাশরুকুর রহমান খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, আতঙ্কের কারণ নেই। সুন্দরগঞ্জে পুলিশের বাড়তি তদারকি রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.