বন্যার কারণে খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা

বন্যার কারণে দেশে কোনো খাদ্য সঙ্কট হবে না বলে সরকার আশ্বস্ত করতে চাইলেও, চাল আমদানিতে ধীরগতির ফলে খাদ্য সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর ড. এম আসাদুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাজারকে প্রভাবিত করার মত মজুদ সরকারের হাতে নেই। "গত ছয় মাস ধরে আমরা শুনছি তারা আমদানি করবেন, কিন্তু আমদানি তারা এখন পর্যন্ত করেন নাই।" তিনি বলেন, সরকার এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৫ হাজার টন চাল আমদানি করতে পেরেছে, আর মজুদ আছে দুই লাখ ১৫ হাজার টন। দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় যদি ব্যাপকভাবে ত্রাণ দিতে হয়, তাহলে সরকার সেটা 'কোথা থেকে দেবে' তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ড. আসাদুজ্জামান। সরকারী তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়, বুধবার পর্যন্ত বন্যাদুর্গত ২০টি জেলায় ত্রাণের জন্য তিন হাজার ১০০ টন চাল মজুদ রয়েছে। কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, সরকারের হাতে অর্থ আছে এবং চাল আমদানি করা হবে। সেই প্রসঙ্গ টেনে ড. আসাদুজ্জামান বলেন, "চীনে এ বছর ফলন কম হয়েছে। তারা এরই মধ্যে চালের বিশ্ববাজারে ঢুকে পড়েছে। আমরা কি চীনের সাথে কম্পিট করে কিনতে পারবো? সেটা সম্ভব হবে না।" তিনি বলেন, এখন টেন্ডার ডেকে চাল আমদানি করতে গেলে তাতেও দুই থেকে আড়াই মাস লেগে যাবে। বাংলাদেশে এক বছরে তিন দফা বন্যার ফলে বিপুল পরিমাণ ফসল নষ্ট হয়েছে এবং আরো অনেক ফসল নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সরকারী হিসেবে হাওর এলাকায় মাস তিনেক আগের বন্যাতেই বোরো উৎপাদন ২০ লাখ টন কম হয়েছে। এবার উত্তরাঞ্চলের বন্যায় আমন ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু মাঠের ফসল নয়, অনেক কৃষকের মজুদ করা গোলার ধানও পচে গেছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে অনেককেই হয়তো ত্রাণের ওপর নির্ভর করতে হতে পারে। লালমনিরহাটের একজন কৃষক শুক্কুর উদ্দিন বলেন, তার চাষ করা ধানের ৯০ শতাংশই প্রায় সপ্তাহখানেক পানিতে ডুবে আছে। তার ধারণা, এই ধানের পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে গোলার ধানও পচে গেছে। ড. আসাদুজ্জামান বলছেন, পানি যদি দ্রুত সরে যায় এবং কৃষি অধিদফতর যদি চারা দিতে পারে, তাহলে হয়তো কৃষকরা আবার কিছুটা আমন চাষ করতে পারবেন।
উত্তরাঞ্চলে ভয়াল রূপ নিয়েছে বন্যা
উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলায় বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দিনাজপুর বা কুড়িগ্রামের অনেক জায়গায় স্থানীয়রা বলছেন তারা জীবনে এরকম দুর্যোগের মুখোমুখি হননি। সরকারি হিসাবেই ২১টি জেলায় অন্তত ৩৩ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৪০ ছাড়িয়ে গেছে। অনেকগুলো জেলায় রাস্তা, রেললাইন ডুবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপদ্রুত লাখ লাখ মানুষ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও উঁচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পুরো দিনাজপুর জেলাই বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে পাঁচদিন ধরে। সেখানকার মানুষ গত প্রায় তিন দশকে বন্যার এত পানি দেখেননি। বন্যায় তলিয়ে থাকা দিনাজপুর শহরের একটি স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ইয়াসিন আলী বলছিলেন, "জেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে গ্রামে আমার ঘরের টিনের চাল পর্যন্ত পানি। ঘরের কিছুই বের করতে পারিনি। শুধু মানুষগুলো বেরিয়ে এসে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। এখানে খাদ্য এবং খাবার পানির অভাবে আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।" একই আশ্রয়কেন্দ্রে দুই শিশু এবং স্বামীসহ উঠেছেন নূরজাহান বেগম। তিনি বলছিলেন,সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা, কারও কাছ থেকেই সেভাবে ত্রাণ সহায়তা তাঁরা পাচ্ছেন না। তিনি বা তার স্বামী একবেলা খেয়েও বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু তিনি কোলের দুই শিশুর খাবার জোগাড় করা নিয়ে চরম দুরবস্থায় পড়েছেন। দিনাজপুরে এবারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আমন ধানের। সেখানকার সাংবাদিক আসাদুল্লাহ সরকার জানিয়েছেন, দিনাজপুরে দুই লাখ আটাত্তর হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়। দিনাজপুরে আগেই আমন ধান রোপন করা হয়েছে। বন্যায় দুই লাখ হেক্টর জমিই পানির নিচে গেছে। নতুন করে আমন রোপনের বীজতলাও নেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পরিস্থিতি সামলে ওঠা বেশ কঠিন হবে বলে তিনি মনে করেন। উত্তরের বন্যা কবলিত আরেকটি জেলা গাইবান্ধার শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। সেখানকার মানুষের মাঝে আতংক তৈরি হয়েছে। জেলাটির পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রৌকশলী মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, "গাইবান্ধাকে রক্ষার জন্য ২২৭ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এই বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ইঁদুর আর উইপোকার গর্ত। এসব গর্ত দিয়ে পানি ঢুকে বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে। তবে গর্তগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। আর এখন পানি কমতে শুরু করায় বাঁধ ভাঙ্গার সম্ভাবনা নেই।" উত্তরের কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাটসহ অন্যান্য জেলাগুলোতেও এবং বিভিন্ন নদীর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় মানুষকে বেশি দুরবস্থায় পড়তে হয়েছে। নদী এবং বন্যা নিয়ে কাজ করেন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ। তিনি বলছিলেন, "কখনও খনন না করায় উত্তরের নদীগুলো সব ভরাট হয়ে গেছে।ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং উজানে ভারত থেকে যে পানির ঢল এসেছে, তা এখানকার নদীগুলো ধারণ করতে পারেনি এবং অনেক নদীর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।" "আর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় অনেক উঁচু হয়ে জ্বলোচ্ছাসের মতো হু হু করে পানি এসেছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। এমন ভয়াবহ পানির তোড়ে অনেক এলাকার মানুষ ভিটেমাটিতে সব ফেলে শুধু নিজের জীবনটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।" উত্তর পূর্বে সিলেট অঞ্চলে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যায় এবার বেশি ক্ষতি হয়েছে। বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলছিলেন, "উত্তরে যমুনা নদীর পানি এখন কমতে শুরু করেছে। এই পানি পদ্মা নদী দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ফলে এখন রাজবাড়ী, শরিয়তপুর, মুন্সিগঞ্জসহ মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যার পানি আসছে।" সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন যে, এবার উত্তরের জেলাগুলোর মানুষ আগের বছরগুলোর তুলনায় বয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছেন। এই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা দাবি করেছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা তারা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.