রায় নিয়ে উত্তেজনা অহেতুক

আমরা রক্ত-মাংসের মানুষ। জৈবিক গঠন অর্থাৎ সৃষ্টি-প্রক্রিয়াতেই আমাদের মধ্যে উত্তেজনার রসায়ন রয়েছে। অতএব আমরা রাগ করব, ক্ষুব্ধ হব, উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ তো ঘটাতেই পারি। আমাদের রিপুগুলোর অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যের মধ্যে কোনটা বেশি খারাপ, কোনটা কম খারাপ তা বিচার-বিশ্লেষণ করে বের করা কঠিন। কম গুরুত্বের বিষয়ও সময়-সুযোগে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এগুলোর আপেক্ষিকতা বিবেচ্য হতে পারে। ছোট্ট শিশু যদি বলে বসে, না, না, আমি মুরগি নই, আমিও মানুষ- তখন এটা যতটা গুরুত্ব পাবে, ট্রাম্প যদি পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় একই কথা বলে বসেন, আগের গুরুত্ব দিয়ে কি তা মাপা যাবে? তবে এটা ঠিক যে উত্তেজিত হলে আমরা ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’ মনে রাখি না। রাগের সুফলও আছে, তবে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ হতে হয়। সম্প্রতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সংসদে যে উত্তেজনার প্রকাশ আমরা টেলিভিশনের কল্যাণে দেখলাম তা আমাদের কাছে, অন্তত আমার কাছে, হাস্যাস্পদ মনে হল, অহেতুক তো বটেই।
কোনো কোনো প্রবীণ সংসদ সদস্যের কণ্ঠের আওয়াজ, দেহভঙ্গি, চেহারার অবয়ব স্ব স্ব উত্তেজনার মাত্রা প্রকাশের বাহন হয়েছে বলা যেতে পারে। এমন হওয়াটা আমরা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিতে পারি এ জন্য যে, রায়ের বিষয়টিকে সংসদ সদস্যরা যতটা না সংসদের ক্ষমতার ‘পরাজয়’ মনে করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি যেন প্রত্যেকে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরাজয় মনে করেছেন এবং সেগুলো পরে সম্মিলিত আকার ধারণ করেছে। সংসদ ও বিচার বিভাগের ‘দৃশ্যত-দ্বন্দ্বের’ এমনতরো বহিঃপ্রকাশ আমরা আগেও দেখেছি। কিন্তু তারপরও আমরা এগুলোকে গণতন্ত্রের অনুশীলন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছি। এখনও তা-ই করব এবং তা করাই বোধহয় শোভনীয়। আমরা ‘ক্ষুব্ধ সংসদ’, ‘উত্তাল সংসদ’, ‘তুমুল আলোচনা’ ইত্যাদিকে রায়ের প্রতি সংসদের প্রতিক্রিয়ার কাগুজে শব্দচয়ন বলে শেষ করতে চাই। কিন্তু স্বচক্ষে যা দেখেছি, স্বকর্ণে যা শুনেছি তা তো আর কাগুজে নয়, তা আমাদের রক্ত মাংসের শরীরের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় হিসেবে বিবেচ্য। আমরা বুঝে উঠতে পারি না, এমনতরো ‘প্রতিক্রিয়ার’ আদৌ প্রয়োজন ছিল কি? একই কথা কি ধীরস্থিরভাবে সুর নামিয়ে বলা যায় না? নাকি মেঠো-বক্তৃতার মতো চড়া গলায় মাইক ফাটানোর মতো করে না বললে বক্তব্যের গুরুত্ব কমে যায়? আমাদের প্রবীণ সংসদ সদস্যরাও কি কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘রাব্বি বেন এজরা’ কবিতার মতো করে ‘গ্রো ওল্ড অ্যালোং উইথ মি! দ্য বেস্ট ইজ ইয়েট টু বি’-এর ধারে-কাছেও যেতে পারেন না? সংসদ সদস্যরা জনপ্রিতিনিধি, যেমন তেমন ভোটে বা ভোট ছাড়াই হোন না কেন তারা আমাদের প্রতিনিধি, তাদের কাছে আমরা আরও পক্বতা আশা করি, যেহেতু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিষয়টা বড় স্পর্শকাতর। এখানেই হুট করে উত্তেজিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, অন্তত যদু-মধু রাম-শ্যামের পর্যায়ে গিয়ে তো নয়ই। অর্বাচীনের মতো বলে ফেললে ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু আমাদের সংসদ আর সংসদ সদস্য নিয়ে কথা বলার অধিকার আমাদেরও আছে, তাই এ বলা।
আমরা হলাম গিয়ে আমজনতা, খাস বাংলায় ‘মুখ্যসুখ্য’ মানুষ। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ দেখতে সবুজ, না লাল, না সাদা, না নীল, না হলুদ এর কিছুই আমরা জানি না। আমাদের কষ্টার্জিত পতাকার রং লাল, সবুজ- এটা আমরা জানি। আমাদের পতাকা এবং দেশকে আমরা ভালোবাসি। এ দুই রং আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী সব সাদা, সবুজ, হলুদ, নীল আমাদের পীড়া দেয়। তারপরও আমরা এ মূর্খরাও ৯৬ অনুচ্ছেদ তদ্বিষয়ক ‘পণ্ডিত’দের মুখে শুনে বুঝতে চেষ্টা করি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভার্সন থেকে পড়ে দেখার চেষ্টা করি। যতটুকু আমরা শুনে বা পড়ে বুঝি তা হচ্ছে, এ অনুচ্ছেদটা হল সুপ্রিমকোর্টের ‘বিচারকদের পদের মেয়াদ’ সম্পর্কিত। এখানে মূলত তাদের পদের মেয়াদ কত বছর বয়স পর্যন্ত এবং অপসারণ কীভাবে হবে তা বর্ণিত রয়েছে। আমরা যা জানতে পেরেছি তাতে বুঝলাম, ১৯৭২-এর মূল সংবিধানে অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ছিল, তারপর চতুর্থ সংশোধনীতে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হল, তারপর পঞ্চশ সংশোধনীতে এটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর গেল এবং সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধনীতে আবার সংসদের হাতে দেয়া হল। আমরা লক্ষ্য করলাম, মূল সংবিধানে অপসারণের ক্ষমতাটা সংসদের হাতেই ছিল। কিন্তু ৯৬ অনুচ্ছেদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে কে নিলেন? সবাই জানি, চতুর্থ সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল এবং দেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় প্রবেশ করল। তা হলে এটা বলা কি বেশি হবে যে বঙ্গবন্ধুই তখন এ সংশোধনী এনেছিলেন? ইতিহাসের অন্যতম হত্যাকাণ্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া পঞ্চম সংশোধনীতে এ ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করেন। পরে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের সময়ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অংশটুকু মার্জনা পেয়ে যায়। লক্ষণীয় বিষয় যে, সামরিক সরকারের অর্থাৎ জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীর এ অংশটুকু তখন সুপ্রিম কোর্টে বহালযোগ্যভাবে বলবৎ থাকা সমীচীন মনে হয়েছে। আমরা ধারণা করতে পারি যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সম্পর্কিত এরশাদের সংশোধনী শেখ হাসিনার কাছে ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য গ্রহণযোগ্য বিবেচনা হলেও জিয়ামার্কা পঞ্চম সংশোধনীর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল থাকা তার কাছে মনঃপুত হয়নি। এ কারণেই ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় একটুু চিন্তা করলে দেখা যাবে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে অপসারণের যে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে আনা হয়েছিল, জিয়া সুকৌশলে রাষ্ট্রপতি হয়েও সে ক্ষমতা নিজের কাছে না রেখে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে সরালেন। ভাবটা এমন যে, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতায় তিনি অদ্বিতীয়। এখানে আমরা জিয়ার বুদ্ধিমত্তাকে অবশ্যই প্রশংসা করব। বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছাড়াই বলা যায়, এ ব্যবস্থাটা বিচার বিভাগ স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করেছে এবং ৫ম সংশোধনী বাতিলেও এ ব্যবস্থা মার্জনা পেয়ে বহাল রেখেছে। ফলে সংবিধানের মূলরূপে ফেরার দোহাইতে গৃহীত ষোড়শ সংশোধনী প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
এ মামলার পরিণতিতে হাইকোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে এবং সর্বশেষ আপিল বিভাগে পূর্ণ ঐকমত্যের ফুলবেঞ্চে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল বহাল রয়েছে। এখন সুপ্রিমকোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আর সংসদের হাতে থাকল না। আপিল বিভাগের রায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল হতাশ বোধ করেছেন। এটা স্বাভাবিক, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা হিসেবে বাহ্যত তাকে হতাশা দেখাতেই হতে পারে, এ সুরে কথা বলতে হতে পারে। আমরা জানি না, ভেতরে ভেতরে এ রায়ে তিনিও খুশি কিনা। আমাদের এমন ভাবনা অবশ্যই অযৌক্তিক কিছু নয়, কেননা পদের কারণে আমরা কোনো কোনো পরিস্থিতিতে নিজের অনুভূতিকে চাপা দিয়ে পদের অনুভূতিই প্রকাশ করি, করতে বাধ্য থাকি। তাকে বাদ দিলে সরকার বা আওয়ামী লীগের (আলী) অনুভূতি আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। দলীয় প্রধান হিসেবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীকে এক বড় ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে। অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে তার ইচ্ছায় সংসদ যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম। ষোড়শ সংশোধনীটা মূলত আমাদের ধারণা, সে ভিত্তিতেই হয়েছে। নচেৎ পঞ্চদশ সংশোধনীতে এত এত বিষয় আনা হলেও ৯৬ অনুচ্ছেদের বিষয়টি এলো না কেন? তখন কি ভুলে তা বাদ পড়েছিল? নাকি ভাবা হয়েছিল, দেখা যাক পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কতদূর গড়ায়, তারপর দেখা যাবে? সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি কি এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে বাজেটে আবগারি শুল্ক কিংবা ভ্যাটের মতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? আরও সোজা করে বললে, বিচারক অপসারণের বিষয়টি কি প্রজাতন্ত্রের মূল ক্ষমতার মালিক জনগণের স্বার্থে আদৌ কোনো বিষয়? আমার তো তা মনে হয় না। কবে কোন কালে, কোন কারণে কোন বিচারক অপসারিত হবেন তাতে ষোলো কোটি মানুষের ক’জনের মাথাব্যথা হবে? এ রকম দৃশ্যত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততাবিচ্ছিন্ন একটা বিষয় নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের এত উষ্মা আমাদের কাছে ভালো ঠেকেনি। একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ণ রায়ের জন্য অপেক্ষা করা অধিকতর কাম্য ছিল। তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তো রয়েছেই, প্রয়োজনে আবার তারা আরেকটা ষোড়শ সংশোধনী পাস করে ফেলবেন, বাধা কোথায়? আমরা খেয়াল করছি যে, মাঝে মধ্যেই একটা-না একটা ইস্যু নিয়ে মিডিয়া বেশ সরব হয়। জনগণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট নিয়ে তো বাজেট মাসই গেল, দিনে দু’লাখ টাকা হাত খরচের সোনা-বেপারির ছেলের কুকীর্তি নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল, তা যেতে না যেতেই আবার ‘ফরহাদ মজহার’ কাহিনী এসে গেল। ফরহাদ মজহারের বিষয়টা বড় ‘রসালো’ বটে, ‘অপহরণ’ না ‘নাটক’ বুঝে উঠতে বোধহয় আরও সময় লাগবে। কিন্তু সংসদ সদস্যরা তো আর আমজনতার মনোভাবের তোয়াক্কা না করে ‘বাচাল’ হতে পারেন না। ষোড়শ সংশোধনী রায়ের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ধীরস্থির মনোভাব এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাবিষয়ক তার বক্তব্য প্রশংসার দাবিদার এবং তার রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। সংসদের সার্বভৌমত্বের মধ্যে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা না থাকলে কি আমাদের সংসদ বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাবে? দেড় বছর পর জাতীয় নির্বাচন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সে নির্বাচনের দিকে অধিকতর মনোযোগী হওয়া বেশি জরুরি, না বিচারক অপসারণের ক্ষমতা কার কাছে থাকবে তার গোঁ নিয়ে অহেতুক উত্তাপ সৃষ্টি বেশি জরুরি- এটা বোধহয় শুধু শেখ হাসিনারই ভাবার বিষয়। আচ্ছা, এ রায়ের পর যদি সংবিধানে আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিস্থাপন না করা হয়, তাতে কি দেশ রসাতলে যাবে? কথিত এ ‘শূন্যতায়’ যদি কোনো বিচারক অপসারিত না-ও হন তাতেও কি এ দেশের গতি থেমে যাবে? তা যদি না হয়, তাহলে আমরা আন্তরিকভাবে বলতে চাইব, রায় নিয়ে উত্তেজনাটা অহেতুক, ধীরে বন্ধু ধীরে, আরও অনেক অনেক বড় কাজ আছে যে!
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.