সিসি ক্যামেরায় নজরদারি তবুও আর্থিক লেনদেন

‘থানায় জিডি কিংবা মামলা করতে এসে টাকা লেনদেন করবেন না। টাকার বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। আপনি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- মো. ওমর ফারুক, অফিসার ইনচার্জ, মতিঝিল থানা।’ এ বিজ্ঞপ্তিটির কয়েকটি কপি মতিঝিল থানার ডিউটি অফিসার এবং সার্ভিস ডেলিভারি অফিসারের কক্ষে সাঁটানো আছে। কিন্তু এরপরও ওই রুমগুলোয় আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। জিডি করে কেউ টাকা দিতে না চাইলে অনেকটা জোর করেই তাদের কাছ থেকে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। বুধবার সরেজমিন মতিঝিল থানায় গিয়ে এ চিত্র চোখে পড়ে। এদিন বেলা ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত মতিঝিল থানায় পাঁচটি জিডি হয়। প্রত্যেকটির বিপরীতে নেয়া হয় টাকা। বেলা ১১টার দিকে যুগান্তরে এ প্রতিবেদক থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় দেখা যায়, ওয়্যারলেস অপারেটর ইকবাল হোসেন পাঞ্জাবি পরা দাড়িওয়ালা এক যুবকের জিডি লিখে দিচ্ছেন। জিডির নম্বর দেয়ার আগেই যুবকের কাছে টাকা দাবি করেন ইকবাল। এ সময় যুবক বলেন, ‘৪০০ টাকা দিলে চলবে স্যার?’ তখন ইকবালের জবাব, ‘আগে যা বলেছি তা-ই দিতে হবে। এক টাকা কম দিলেও চলবে না।’ পরে ওই যুবক ৫০০ টাকার একটি নোট ইকবালের হাতে দিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে ওই যুবকের পিছু নিয়ে যুগান্তরের প্রতিবেদক পরিচয় জানতে চান। তখন যুবক জানান, তার নাম মো. সারোয়ার। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দায়। তিনি পেশায় কৃষক। ভারতীয় ভিসা করাতে মতিঝিলে এসেছেন। আগের পাসপোর্টটি হারিয়ে গেছে। তাই থানায় জিডি করতে এসেছিলেন। তার জিডি নম্বর ৮৩২। তিনি বলেন, ‘জিডি করার আগেই পুলিশ সদস্য ইকবাল আমার কাছে ৫০০ টাকা দাবি করেন। জিডি শেষে তাকে ১০০ টাকা কম দিতে চেয়েছিলাম। এজন্য টাকা ভাঙতি করেও এনেছিলাম। কিন্তু তিনি কম নিতে রাজি হননি।
তাই বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা দিয়েছি।’ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ফের ডিউটি অফিসারের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন নিজেই একটি জিডি লিখছেন। এ সময় ওয়্যারলেস অপারেটর ইকবাল হোসেন তাকে বলেন, ‘দেন, আপনার জিডি আমি লেখে দিই।’ বেলাল হোসেন আপত্তি না জানালে পুলিশ সদস্য ইকবাল জিডি লেখা শুরু করেন। জিডি লেখা শেষে ইকবাল একটি কপি টেবিলের ওপর রেখে বেলাল হোসেনকে বলেন, ‘এটি আপনার কপি।’ বেলাল কপিটি হাতে নেয়ার সময় ইকবাল টাকা দাবি করেন। বেলাল হোসেন ১০০ টাকা দিলে ইকবাল তা নিতে রাজি হননি। বেলালকে এ সময় ইকবাল বলেন, ‘আপনারা ব্যবসায়ী মানুষ। ১০০ টাকা কীভাবে দেন?’ জবাবে বেলাল বলেন, ‘ঈদের পর থেকে ব্যবসার অবস্থা ভালো না। পকেটে মাত্র ২০০ টাকা আছে। ১০০ টাকার বেশি আপনাকে দিতে পারব না।’ ইকবাল কোনো মতেই ১০০ টাকা নিতে রাজি নন। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে দর কষাকষির একপর্যায়ে ইকবাল বারবার যুগান্তরের প্রতিবেদকের দিকে তাকাচ্ছিলেন। পরে প্রতিবেদক ডিউটি অফিসারের কক্ষ ত্যাগ করে সার্ভিস ডেলিভারি অফিসারের কক্ষে অবস্থান নেন। বেলাল হোসেন থানা থেকে বেরিয়ে আসার পর তার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের প্রতিবেদকের। বেলাল বলেন, ‘পুলিশ সদস্য ইকবাল নিজ ইচ্ছায় জিডি লিখে দেন। জিডি লেখার আগে কোনো টাকা দাবি করেননি। পরে টাকা চাইলে তার ১৫ মিনিটের পারিশ্রমিক বাবদ ১০০ টাকা দিই। কিন্তু তিনি ওই টাকায় সন্তুষ্ট নন। দীর্ঘক্ষণ দরকষাকষির পর তার (ইকবাল) ফাইলের নিচে ১০০ টাকা গুঁজে দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে টেবিল থেকে আমার জিডির কপিটি নিয়ে চলে আসি।’ বেলাল হোসেন বলেন, একদিকে টাকা দিতে নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো হয়েছে। অন্যদিকে জোর করে টাকা নিচ্ছে। তাও আবার সিসি ক্যামেরা চালু থাকা অবস্থায়। এটা কোন ধরনের নীতি? তার মতে, থানায় থাকা সিসি ক্যামেরাগুলো ওসির রুম থেকে মনিটরিং না করে পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটরিং করা উচিত। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সার্ভিস ডেলিভারি অফিসারের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সবুজবাগের বাসিন্দা আলমগীর তার জিডির কপিটি নিয়ে সার্ভিস ডেলিভারি অফিসার নিশাত জাহানের সামনে থেকে উঠে বাইরের দিকে রওনা দিচ্ছেন। এ সময় নিশাত জাহান বলেন, ‘খরচাপাতি দিয়ে যান।’ উত্তরে আলমগীর বলেন, ‘আমাকে রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এক স্যার পাঠিয়েছেন। পাঠানোর আগে তিনি বলেছেন, জিডি করতে কোনো টাকা লাগবে না।’ এরপর পুলিশ সদস্য নিশাত জাহান বলেন, ‘যে স্যারই পাঠিয়ে থাকুক না কেন, টাকা লাগবে।’ পরে আলমগীর তার পকেট থেকে ১০০ টাকা বের করে দেন। কিন্তু সার্ভিস ডেলিভারি অফিসার ১০০ টাকা নিতে রাজি হননি। একপর্যায়ে আলমগীর বলেন, ‘আমরা গরিব লোক। আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই। এখান থেকে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যেতে হবে হেঁটে।’ পরে সার্ভিস ডেলিভারি অফিসার নিশাত জাহান ১০০ টাকা নিয়ে তার ভ্যানিটি ব্যাগের সামনের চেইন খুলে ভেতরে রেখে দেন। এরপর বেরিয়ে যান আলমগীর। ১২টা ২০ মিনিটের দিকে থানা থেকে জিডি করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আলমগীরের সঙ্গে কথা হয়। আলমগীর জানান, তার স্থায়ী ঠিকানা ময়মনসিংহ সদরের বিদ্যাগঞ্জ এলাকায়। মঙ্গলবার ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি এলাকায় তার রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাগজপত্র হারিয়ে যায়। এজন্য জিডি করেছেন।
তার জিডি নম্বর ৮৩৭। তিনি বলেন, ‘জিডি করতে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্ভিস ডেলিভারি অফিসার আমার কাছে ২০০ টাকা দাবি করেন। ২০০ টাকা না থাকায় শেষ পর্যন্ত ১০০ টাকা দিয়েছি।’ ‘জিডি করতে কত টাকা করে নেন’- জানতে চাইলে দায়িত্বরত সার্ভিস ডেলিভারি অফিসার নিশাত জাহান বিব্রত বোধ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রশ্নটা কেমন হয়ে গেল না ভাই? আপনি তো একটি জায়গায় আছেন। এ রকম প্রশ্ন করা কি ঠিক?’ ‘আপনি তো টাকা নিচ্ছেন। যদি না নিতেন, তাহলে প্রশ্নটা করতাম না’, যুগান্তর প্রতিবেদকের এ মন্তব্যের পর নিশাত জাহান বলেন, ‘যে যে রকম দেয় সেরকমই নিই।’ একই ধরনের জবাব দিয়ে ওয়্যারলেস অপারেটর ইকবাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলা বা জিডির ক্ষেত্রে টাকা নেয়ার কোনো নিয়ম নেই।’এ বিষয়ে মতিঝিল থানার ওসি ওমর ফারুক, পরিদর্শক (তদন্ত) গোলাম রব্বানী এবং পরিদর্শক (অপারেশন) মনির হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও তাদের থানায় পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, ওসি ওমর ফারুক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। বুধবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে পরিদর্শক (তদন্ত) গোলাম রব্বানী যুগান্তরকে বলেন, ‘এমন তো হওয়ার কথা নয়। ওই সময় আমরা (ওসি ও দুই পরিদর্শক) থানায় ছিলাম না। এ সুযোগে হয়তো টাকা-পয়সা নিয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.