এসে রমজান চলে যায় বয়স ফুরায়

রোজার মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে তাকে মুক্ত করে তার ভেতর তাকওয়া খোদাভীতি ও আল্লাহপ্রেম জাগ্রত করে দেন। তাকে সেই সত্য-সুন্দরের পথে পরিচালিত করতে চান, যে সত্য-সুন্দরের পথ তাকে নিয়ে যাবে সফলতা ও মুক্তির দরজায়। তার ভেতর সৃষ্টি করে দেবেন প্রেম, আর এ প্রেমই তাকে নিয়ে যাবে পূর্ণ আনুগত্য ও সন্তুষ্টির পথে, সে ক্রমেই পাগলপারা হয়ে উঠবে তার প্রেমিক আল্লাহকে পাওয়ার জন্য। তখন প্রতিটি সৎ কাজ ও আল্লাহর বিধানে সে খুঁজে পাবে প্রশান্তি। অসৎ ও যে কোনো পাপ তাকে পীড়া দেবে। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সে হবে দরদি। তার ভেতর জাগ্রত হবে মনুষ্যত্ব, মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে মতো মানবিক গুণাবলী। এর ফলে তার মনে থাকবে না হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অরাজকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। খতম হবে তার অহমিকা ও আমিত্ববোধ (যা হাজারও অন্যায় ও অনাচারের জন্মদাতা) সৃষ্টি হবে হৃদয়জুড়ে ভালোবাসা। এ উদ্দেশ্যে ও শিক্ষা নিয়েই প্রতি বছর মাহে রমজান মুসলিম উম্মাহর দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। এবারও এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে শিক্ষা ও উদ্দেশ্য নিয়ে রমজান আমাদের মাঝে এসেছে সে শিক্ষা আমরা অর্জন করতে পারি কিনা? সত্যিকার অর্থে বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রমজানের শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত, যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ আমাদের জন্য রমজানের বিধান দিয়েছেন তা আমরা অর্জন করতে পারছি না, রমজান আমাদের জীবনে তেমন কোনোই পরিবর্তন আনছে না। রমজান এলে ইবাদত-বন্দেগিতে ঠিকই হয়তো মনোযোগী হচ্ছি কিন্তু রমজান চলে গেলে সেই আগের মতোই তা ছেড়ে দিচ্ছি। রমজানের আগে যেমন পাপাচার-অনাচারে ডুবেছিলাম রমজানের পরে আবার ডুবে যাচ্ছি। রমজানের আগে যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, পণ্যে ভেজাল করা, কালোবাজারি, মজুদদারি, মাপে কম দেয়া, ধোঁকাবাজি, ছলচাতুরি, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি অমানবিক কর্মে ছিলাম রমজানের পরে ঠিক আগের মতোই এসব করে যাচ্ছি। তাহলে রমজান আমার জীবনে কি পরিবর্তন আনল?
রমজান থেকে আমি কী শিক্ষা অর্জন করলাম? রমজানের আগে যেমন একজন ব্যথিত, পীড়িত মানুষকে দেখে তার জন্য আমার দরদ সৃষ্টি হতো না রমজানের পরেও হচ্ছে না। যুগ যুগ ধরে এটাই আমরা লক্ষ্য করছি। অথচ রাসূল (সা.)-এর সাহাবি ও পূর্বসূরি মনীষীদের জীবনের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় একটি রমজানই তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। রমজানের পরে তাদের কার্যকলাপে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, অথচ আমাদের জীবনে তা হচ্ছে না। তাহলে বোঝা যায়, নিশ্চয় কোথাও আমাদের ত্রুটি রয়েছে। আর সে ত্রুটি হল, আমরা কেবল না খেয়ে থাকা বা উপবাসব্রতকে রোজা বা সিয়াম সাধনা মনে করছি, অথচ পানাহার ও কামবৃত্তি থেকে বিরত থাকা রোজার একটি অংশবিশেষ, এটুকুর নাম রোজা নয়। হাত-পা, কর্ণ-নাসিকা, চোখ-মুখ, মেধা-মনন, অন্তর-আত্মা, চিন্তা-গবেষণা অর্থাৎ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রয়েছে রোজা। সেগুলোর প্রতি আমরা একটুও খেয়াল করছি না, ফলে রোজা আমাদের জীবনে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না। সুতরাং ত্রুটিমুক্ত না হয়ে যদি আমরা সিয়াম সাধনা করি তাহলে আমার সিয়াম সাধনা কোনোই কাজে আসবে না। তাই আসুন রোজাদার ভাইরা! রোজার প্রকৃত শিক্ষা ও উদ্দেশ্যের প্রতি যতœবান হয়ে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করি, মানবিক গুণাবলীতে জীবনকে করি আলোকিত। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে পরস্পরে গড়ে উঠবে মধুর সম্পর্ক, সমাজ থেকে বিদায় নেবে অরাজকতা, অন্যায়-অনাচার। এভাবে দুর্নীতি ও ভেজালমুক্ত হয়ে আদর্শ জাতি হিসেবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। খুঁজে পাব সফলতা। তা না হলে রমজান আসবে, রমজান যাবে, আমরা কিছুই পাব না। আল্লাহতায়ালা আমাদের এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : শায়খুল হাদিস, খতিব ও প্রাবন্ধিক
muftizahir@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.