ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচন আজ

আজ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচন। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। কনজারভেটিভ, লেবার পার্টিসহ প্রধান দলগুলো ভোটারদের কাছে তাদের দলের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে ভোট চেয়ে কয়েক সপ্তাহজুড়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে। ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নির্বাচনী প্রচারে কিছুটা ছেদ পড়ে। দু-দুটি হামলার পর শেষ মুহূর্তে নির্বাচনী প্রচারে নিরাপত্তা ইস্যুই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সামগ্রিক বিচারে ব্রেক্সিট, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা, মানবাধিকার আইনসহ মূল দাবিগুলোকেই প্রচারের আলোতে এনেছেন প্রধান দুই দলের কাণ্ডারি তেরেসা মে ও জেরমি করবিন। এটি গণতন্ত্রকে সূতিকাগার ব্রিটেনের ৫৭তম সাধারণ নির্বাচন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সাল থেকে আধুনিক ব্রিটেনে এটি ১৯তম পার্লামেন্ট নির্বাচন। ৫ বছর পরপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনটি হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে এ চল মেনে আসছে ব্রিটিশ নাগরিকরা। ১৯৭৪ সালে একই বছর দু’বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংকটে পড়লে ওই বছর ফেব্রুয়ারি এবং অক্টোবরে দু’দফা নির্বাচন করতে হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন অতীতের সব ধারাবাহিকতা বজায় রেখে শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর গণতান্ত্রিক এই দেশে নির্বাচন পরিচালনা করতে বরাবরের মতো এবারও প্রস্তুত। এবারের নির্বাচনটি নিয়ম অনুযায়ী ২০২০ সালে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসা) বাস্তবায়ন প্রশ্নে নিজের ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করতে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে হুট করেই মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘোষণা দেন। আজ হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনে ভোট হবে। অধিকাংশ প্রার্থীই সাতটি রাজনৈতিক দলের। তবে কয়েকজন স্বতন্ত্র হিসেবেও লড়ছেন। ব্রিটেনের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি ও প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির মধ্যেই। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টি, গ্রিন পার্টি, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি-এসএনপি, পেইড কামরু পার্টিও লড়ছে। এর বাইরেও কিছু ছোট ছোট দল থেকে কয়েকজন প্রার্থী হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ৩ হাজার তিনশ’ চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গত পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তিন হাজার নয়শ ৬৮ জন।
জরিপে এগিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি : ২ জুন ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের সবশেষ জনমত জরিপে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি এবং লেবার পার্টির মধ্যে ব্যবধান কমে এসেছে। কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন ৫৩ শতাংশ, লেবার পার্টির ৪৭ শতাংশ। ডেইলি টেলিগ্রাফের মতে, কনজারভেটিভ ৩১০টি আর লেবার পার্টি ২৫৭টি আসন পেতে পারে। তাদের হিসাবে এবারও কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ৩২৬টি আসনের দরকার। অন্যান্য জনমত জরিপেও এখন পর্যন্ত কনজারভেটিভ পার্টি কিছুটা এগিয়ে। যদিও ব্যবধান অনেকটাই কমে এসেছে। নির্বাচনী প্রচারের শুরুর দিকে লেবার পার্টি অনেক পিছিয়ে ছিল। সম্প্রতি কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনায় লেবার পার্টির জনমত বেড়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। শেষ মুহূর্তের প্রচার : মঙ্গলবার ছিল প্রচারের শেষ দিন। এ দিনে কনজারভেটিভ দলের নেতা তেরেসা মে বলেন, ব্রেক্সিটেরপর যুক্তরাজ্যে চাকরির পরিমাণ বাড়বে; বাড়বে বাড়িঘর, আরও উন্নত হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা। অন্যদিকে লেবার পার্টির নেতা করবিন ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের র‌্যালিগুলোতে বলেছেন, জাতীয় স্বাস্থ্য খাতকে বাঁচাতে ভোটারদের হাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা সময় আছে। কনজারভেটিভদের নীতিতে জাতীয় স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক নিরাপত্তাসহ পুলিশের সংখ্যা এবং পেনশনের পরিমাণ কমে যাবে বলে নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে লেবাররা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে বলছেন, নির্বাচিত হলে তিনি সন্ত্রাসী হামলা মোকাবেলায় প্রয়োজনে যুক্তরাজ্যের এখনকার মানবাধিকার আইনের সংস্কার করবেন। নির্বাচনের প্রচারণার মধ্যেই মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে দুটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশ জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। তাই শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় প্রধান প্রধান দল জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে একে অন্যের দুর্বলতা খুঁজে ঘায়েল করতেই ব্যস্ত। শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরমি করবিনকে একজন দুর্বল ও দেশ চালাতে অক্ষম নেতা হিসেবে আক্রমণ করে আসছেন। কিন্তু গত আড়াই মাসে তিনটি সন্ত্রাসী হামলার পর জেরেমি করবিন পাল্টা আক্রমণে। তিনি বলছেন, গত সাত বছরে ক্ষমতাসীনরা পুলিশের বাজেট কাটার কারণে পুলিশ সদস্য প্রায় ২০ হাজার কমে গেছে। তহবিল ঘাটতির কারণে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় রসদ পুলিশের হাতে নেই। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মেকে তিনি সরাসরি দায়ী করেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনিই ২০১০ সাল থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজ এলাকায় দুই দফা সন্ত্রাসী হামলার কারণে নির্বাচনী প্রচারে ছিল নিরাপত্তার কড়াকড়ি। শেষ দিনে কনজারভেটিভ শীর্ষ নেতা মে প্রচার শুরু করেন লন্ডন থেকে; এরপর যান সাউথ কোস্ট, নরফোক, নটিংহ্যামশায়ার এবং ওয়েস্ট মিডল্যান্ডে। পুরো প্রচারেই মে বলেছেন, ব্রেক্সিটের কথা,
যা নিশ্চিত করতেই ৫০ দিন আগে হঠাৎ করেই আগাম নির্বাচনের ডাক দেন তিনি। মের দাবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পেছনে আগে যুক্তরাজ্যের যে ব্যয় হতো, তা বেঁচে যাওয়ায় ‘বিশাল উপকার’ হবে। তিনি কনজারভেটিভদের প্রতিশ্রুত ২৩ বিলিয়ন পাউন্ডের ন্যাশনাল প্রডাক্টিভিটি ফান্ডের ব্যাপারে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন; বলেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যজুড়ে বাড়িঘর, রাস্তা, রেল ও ব্রডব্যান্ড যোগাযোগের উন্নতি হবে। মে বলেন, বছরখানেক আগে ব্রিটেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে গিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়েছিল। আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করা, যেন তা যুক্তরাজ্যের চারদিকে পৌঁছে যায়; ব্রেক্সিটের সুযোগ আমাদের দেবে আরও বেশি চাকরি, আরও বাড়িঘর, ভালো সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং বিশ্বমানের ডিজিটাল যোগাযোগ, যেখানেই আপনি থাকুন না কেন। অন্যদিকে লেবার পার্টির শীর্ষ নেতা জেরমি করবিন বলছেন, জাতীয় স্বাস্থ্য খাত আরও পাঁচ বছর অর্থ সঙ্কট, কর্মচারী সংকট ও বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বার্মিংহামে গানের অনুষ্ঠানের মতো করে আয়োজিত এক নির্বাচনী র‌্যালিতে তিনি বলেন, কনজারভেটিভরা বলছে, নির্বাচনের পর তারা শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকার উপহার দেবেন। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্ব^ী ছাড়াও প্রচার চালিয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক ও গ্রিন পার্টির নেতারা। লিবারেল ডেমোক্রেটদের শীর্ষ নেতা টিম ফেরন প্রধানমন্ত্রী মেকে ‘খোলা চেক’ না দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পরপর দুবার ২০১০ এবং ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি সরকার পরিচালনা করে। এর আগে পরপর তিনবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে লেবার পার্টি ১৯৯৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।

No comments

Powered by Blogger.