বিশ্ব বাজারে ঘিওরের লেবু

লেবুচাষ পাল্টে দিয়েছে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার অর্থনৈতিক দৃশ্যপট। উপজেলার বালিয়াখোড়া ও সোদঘাটা গ্রামের প্রায় ৭শ পরিবারের দুই সহস্রাধিক লোক লেবু চাষের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার চাষিরা কলম্বো, এলাচি ও কাগজী জাতের লেবু চাষ করেন। এলাচি জাতের লেবু স্বাদে ভালো হলেও ফলন কম হওয়ায় চাষিরা কলম্বো জাতের লেবু বেশি চাষ করছেন। বাইরের যে কেউ গ্রামে ঢুকলে অবাকই হবেন। বাড়ির উঠান, আঙিনা যেখানেই ফাঁকা জায়গা, সেখানেই লেবু গাছ লাগানো হয়েছে। এখানকার চাষীদের উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের লেবু ঢাকার পাইকারদের মাধ্যমে দেশ ছাড়িয়ে স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব বাজারে। শুর”তে নিজেদেরর পরিবারের চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে লেবু চাষ করা হয় । অল্প খরচে বেশি উৎপাদন ও অধিক লাভজনক হওয়ায় আস্তে আস্তে লেবু চাষের বিস্তৃতি বাড়তে থাকে। এর পর শুর” হয় বানিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ। ১৫/১৬ বছর আগে চাষ শুরু হওয়া গ্রাম দুটিতে এখন রীতিমত অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে এ দুটি গ্রামে প্রায় ৭ শত পরিবার লেবু চাষের উপর নির্ভরশীল। এখানকার চাষীরা কলম্বো, এলাচী ও কাগজী জাতের লেবু চাষ করে থাকে। চাষীরা জানান, সাধারনত বছরে আশ্বিন মাসে লেবুর চারা বোপন করা হয়। তারপর ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশ ও জৈব সারসহ পানি সেচ দেওয়া হয়। চাড়া বপনের দুই বছর পর লেবু ধরা শুর” হয়। প্রতি বিঘায় লেবু চাষ করতে সবকিছু মিলে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকে। এতে এক বিঘা জমিতে বছর প্রতি ৫০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করা হয়। একবার লেবু বাগান করলে গড়ে প্রায় ১০/১২ বছর সেখান থেকে লেবু পাওয়া যায়। সে হিসাবে উৎপাদন খরচ উঠতে প্রথম দুই বছর লেগে যায়। ৩য় বছর থেকে লাভ পাওয়া যায়। সাধারনত বছরের ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে লেবুর মৌসুম হলেও বছরের প্রায় বারো মাসই কম বেশি লেবু তোলা হয়। উৎপাদিত এসব লেবু স্থানীয় বাজার এবং জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকার কাওরান বাজারে বিক্রি হয়ে থাকে। সেখানে লেবু বিক্রি করা হয় পণ হিসেবে। ২০ হালিত ১ পণ। সম্প্রতি ঘিওরের এই কলম্বো লেবু বিশ্বের কয়েকটি দেশেও রফতানী হচ্ছে। বাগান থেকে লেবু তোলার পর বাছাই করে বড়, মাঝারি, ছোট ও কেট এই চার ভাগে ভাগ করা হয়।
লেবুর মৌসুমে ঢাকায় প্রতি পণ লেবু ৪শ থেকে ৫০ শত টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বাজারে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পণ হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে বলে স্থানীয় পাইকাররা জানান। বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সফল লেবু চাষী মোঃ আওয়াল খান জানান, সোদঘাটা গ্রামে প্রায় ১০ বছর আগে তিনি ১২ বিঘা জমিতে লেবু বাগান করেন। চারা বোপনের প্রথম বছর ১১/১২ লাখ টাকা খরচ হয়। তারপর বাগান পরিচর্যা করার জন্য বিঘা প্রতি ১৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়। এবার তিনি ৫ লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেছেন বলে জানান। স্বল্প সময়ে ও কম পরিশ্রমে লেবু চাষে দীর্ঘ মেয়াদী অধিক মুনাফা লাভ করা যায় বলে তিনি বেকার যুবক যুবতীদের লেবু চাষে এগিয়ে আসার অঅহবান জানান। বালিয়াখোড়া গ্রামের লেবু চাষি মজিবুর রহমান ১৬-১৭ বছর ধরে লেবু চাষ করেন। এক বিঘা জমিতে কলম্ব জাতের লেবু চাষে তার খরচ পড়ে প্রায় এক লাখ টাকা। আর বছরে লেবু বিক্রি করেছেন ৫০ হাজার টাকার। একই গাছ থেকে ১০-১২ বছর লেবু বিক্রি করতে পারেন তিনি। প্রতিবছর বাগান পরিচর্যায় খরচ হয় ১৪-১৫ হাজার টাকা। চাষিরা জানান, চারা বপনের দুই বছর পর লেবু ধরতে শুর” করে। প্রথম দুই বছরেই খরচ উঠে যায়। বিদেশে বিভিন্ন সবজীজাত পণ্য রপ্তানীকারক ঢাকার ব্যবসায়ী মোঃ ফারুক খান বলেন, চৌধুরী চলতি মৌসুমে সৌদি আরব, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৫ টন লেবু রপ্তানি করা হয়েছে। বেশিরভাগ লেবুই তিনি সংগ্রহ করেন মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে। ঘিওর উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা আশরাফ উজ্জামান জানান, ঘিওরের বালিয়াখোড়া ও সোদঘাটা গ্রামের চাষীরা লেবু চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন। এ অঞ্চলের লেবুর কদর রয়েছে সারা দেশে। এখন বিদেশীদেরও খাবার তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে ঘিওরের লেবু। এ দুই গ্রামের কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎস লেবু চাষ। লেবু চাষীদের সব রকম সহযোগিতা করে থাকেন বলে জানান। তবে সরকারী সাহায্য ও পরামর্শ এবং সহজ শর্তে ঋণ পেলে শুধু এ গ্রাম দুটি নয় পুরো ঘিওর উপজেলার চাষীরা লেবু চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হবে বলে চাষীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.