হাওরের দুঃখ-কষ্ট এবং হার না-মানা মানুষ

উজান থেকে আসা প্রবল ঢল ও অকালবৃষ্টিতে যখন হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছিল, তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আধিকারিকেরা বিপন্ন ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াননি। স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সরেজমিনে এলাকা পরিদর্শনের প্রয়োজন বোধ করেননি। বাঁধ নির্মাণকাজে দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে হাওরে কান্না থামবে না। গত ২৯ এপ্রিল সুনামগঞ্জে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে দুজন সাংসদ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। তাঁদের মতে, হাওরের দুর্যোগ পুরোপুরি মানবসৃষ্ট। পাউবোর নীতিনির্ধারকেরা দুদকের কাছে স্বীকার করেছেন, তাঁদের কাজে গাফিলতি ছিল। কিন্তু পাউবোর সামান্য গাফিলতি যে হাওরবাসীর জন্য অসামান্য ক্ষতি বয়ে এনেছে, তার জবাব কী।
হাওর বাঁচাও মানুষ বাঁচাও
ব্যক্তিগত আলাপে হাওর বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলনের নেতাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীভাবে এটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ? জবাবে তাঁরা যা জানালেন, তার সারমর্ম হলো, এই সমস্যা এক দিনে হয়নি। প্রতিবছর নদী ও হাওরে প্রচুর পলি জমলেও তা খনন বা সরানোর উদ্যোগ নেই। হাওরের সমস্যা সমাধানে সরকারের সমন্বিত প্রয়াস বা জোরদার কর্মসূচি নেই। যখন হাওরের ফসল বানে ভাসিয়ে নেয়, তখন হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কানাডা সফরে ছিলেন উচ্চতর জ্ঞান লাভ করতে। তাঁদের মতে, নদী ও হাওরগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ করে রাখতে পারে না। হাওরের আকার অনেকটা গামলামতো। চারদিকটা উঁচু থাকে। নিচটা গভীর, যা বিল নামে পরিচিত। সেখানে সব সময়ই পানি থাকে এবং মাছের চাষ হয়। উপরিভাগে ধানের চাষ। বন্যা রোধে সেখানে ডুবো বা অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়। এই বাঁধের কাজ এপ্রিল-মে মাসে শেষ হয়। অনেক সময় বাঁধের ঠিকাদারেরা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন, এবার বৃষ্টিটা যেন পরে আসে। ধান ওঠার পর বৃষ্টি এলে, বাঁধ হয়েছে কি না কেউ খোঁজ নেয় না। বৃষ্টির মধ্যে কিছু মাটি ফেলে বরাদ্দের পুরো টাকাই তুলে নেওয়া হয়।
হার না–মানা হাওরবাসী
ওই গোলটেবিল বৈঠকে এমন তিনজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁধ রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। কেউ দুই সপ্তাহ, কেউ তিন সপ্তাহ বাঁধ টিকিয়ে রেখেছেন। সুনামগঞ্জে যখন একের পর এক হাওর ডুবছিল, তখন স্বেচ্ছাশ্রমে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা চলছিল। টানা ২৪ দিন পানি আটকে রাখার কাজে নেতৃত্ব দেন তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল ও জামালগঞ্জ উপজেলার বেহিলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নারী ওয়ার্ড সদস্য মনেছা বেগম। প্রথম আলোর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি খলিল রহমানের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের বাঁধ যখন ঝুঁকির মুখে পড়ে, কৃষকেরা যখন ছুটে যান বাঁধ রক্ষায়, তখন তাঁদের পাশে দাঁড়ান স্থানীয় লম্বাবাক গ্রামের রজব আলী, উত্তর কামলাবাজ গ্রামের শহীদুল ইসলাম, আবদুল খালেক প্রমুখ। একইভাবে জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনার হাওরের বাঁধ রক্ষায় কয়েক শ কৃষকের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের উৎসাহ দিয়েছেন স্থানীয় ফেনারবাক ইউপির প্রবীণ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু তালুকদার, স্থানীয় সংবাদকর্মী আক্তারুজ্জামান, আকবর হোসেন, ওই ইউপির সচিব অজিত কুমার রায়, স্থানীয় বাসিন্দা দিল আহমদ প্রমুখ। দিরাই উপজেলার বরাম হাওরের বাঁধ যখন ঝুঁকির মুখে পড়ে, কৃষকেরা যখন অস্থির, তখন তাঁদের পাশে দাঁড়ান দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র লন্ডনপ্রবাসী আজিজুর রহমান। তিনি বাঁশ, বস্তা, চাটাই কিনে নিজে এসব নিয়ে যান বাঁধে। সেই সঙ্গে কৃষকদের প্রতিদিন শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া দিরাই ও শাল্লায় একইভাবে কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করছেন প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত। অন্যদিকে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী হাওরে পাহাড়ি ঢল মোকাবিলায় কৃষকদের ‘মানবঢালে’ অংশ নেন কৃষক অমর চাঁদ দাশ। অমর চাঁদ ঐক্য ন্যাপের নেতা। বান ঠেকাতে তাঁরা বাঁশের খুঁটি গেড়ে ঢাল তৈরি করেছিলেন, যাতে পানির তোড়ে কেউ ভেসে না যায়।
নির্বিকার প্রশাসন
আমরা জনপ্রতিনিধদের যতই গালমন্দ করি না কেন, মানুষের বিপদে তাঁরা পাশে দাঁড়ান। পাউবোর কর্তাব্যক্তিদের মতো মওকা খোঁজেন না। গণমাধ্যমে বানের খবর আসার পরও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছিলেন নির্বিকার। পাঁচ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার পরও মুঠোফোনে তাঁরা বিভিন্ন এলাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিয়েছেন। খুব কম সরকারি কর্মকর্তাই এলাকায় গিয়েছেন। একজন নারী সাংসদ আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমি মহিলা মানুষ হয়ে হাওর এলাকায় প্রতি সপ্তাহে একবার করে যাচ্ছি, আর আপনি পুরুষ মানুষ হয়ে এক দিনও যেতে পারলেন না?’ তৃণমূল থেকে পাঠানো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জেলা প্রশাসন থেকে সব উপজেলায় এবং উপজেলা প্রশাসন থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সব এলাকায় তো বন্যার মাত্রা ও ক্ষতির পরিমাণ এক নয়। আর বাংলাদেশ যে দুর্যোগ মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছে বলে সরকার বাহ্বা কুড়াচ্ছে, তার মূলে রয়ে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। তারা নিজেরাই বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে নেয়।
ক্ষয়ক্ষতি ও সরকারের ত্রাণনীতি
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের (ডিডিএম) বরাত দিয়ে বণিক বার্তা জানায়, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ফসলহানি, মাছ ও প্রাণিসম্পদ, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট এবং কর্মঘণ্টার যে ক্ষতি, তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। গত ২৮ মার্চ সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার—এ ছয়টি জেলায় বন্যা শুরু হয় গত ২৮ মার্চ। এতে ৬২ উপজেলার ৫৪১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫১৮টি প্লাবিত হয়। তলিয়ে যায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ধান। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ছয় জেলায় পরিবারের সংখ্যা ২৮ লাখ ৯৭ হাজার। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বন্যায় নানাভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি বা ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে চিহ্নিত করলেও হাওরবাসী মনে করেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বেশি। সরকার মাসে পরিবারপ্রতি ৩০ কেজি চাল ও এক হাজার টাকা সহায়তা, খোলাবাজারে চাল বিক্রি, ঋণের কিস্তি স্থগিত ও ঋণ অর্ধেক মওকুফ, বিনা মূল্যে সার ও বীজ দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বেতন ও ফির বিষয়ে কিছু বলেনি। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মতে, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বন্ধ করতে হলে বেতন-ফি মওকুফের পাশাপাশি তাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু ধরমপাশা উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ৩৩ হাজার ১৫৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩ হাজার ৫১৫ জন অংশ নিতে পারেনি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন সমাজসেবার সঙ্গে জড়িত একজন। হাওর এলাকায় অনেক বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়ে আছে। বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ায় অভিভাবকেরা এবার ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। এ কারণে তাঁদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে হাওর এলাকায় বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্থায়ী সমাধান চাই
প্রায় প্রতিবছর হাওরে বন্যা হয়। এর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। পাউবো বা পিআইসির মাধ্যমে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো অস্থায়ী। হাওরের সব জায়গায় না হলেও কিছু জায়গায় স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে উজান থেকে আসা ঢলের পানি যাতে নদী ও হাওর ধারণ করতে পারে, সে জন্য নদী ও বিল খনন করতে হবে। নদীর নাব্যতা বাড়লে বন্যার প্রকোপ কমে যাবে। বর্তমানে হাওরে যেসব ধান চাষ করা হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি। কোনো কোনোটিতে পাঁচ–ছয় মাস পর্যন্ত লেগে যায়। এখন হাওরের উপযোগী স্বল্পমেয়াদি ধান উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা খুবই মেধাবী। তাঁরা বিভিন্ন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। গবেষণা সহায়তা পেলে হাওরের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খায়, এ রকম ধানও উদ্ভাবন তাঁরা করতে পারবেন। প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। তবে হাওরের ক্ষতির মাঝে কিছুটা আশার খবর শুনিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ব-দ্বীপ এলাকার মাছ ও ফসল উৎপাদনে বন্যা কেবল ক্ষতিকর নয়, আশীর্বাদ হয়েও আসে। বন্যার কারণে পলি বয়ে আনায় মাটির গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়সহ জলাশয়গুলোতে বন্যার কারণে পানির গুণগত মান ভালো হয়। হাওরে এবার বড় ধরনের পানিদূষণ হলেও আগাম পানি আসায় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, পিএইচের মাত্রা এখন ৭ দশমিক ৫। মাছের প্রজনন শুরু হয়ে গেছে। পচে যাওয়া ধানগাছ থেকে গ্লুকোজ কনভারটেড হয়ে মাছের খাবার তৈরি হবে। হাওরে পোনা ছাড়া হলে প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে মাছ সহজেই বড় হওয়ার সুযোগ পাবে। আগাম বৃষ্টির কারণে অক্টোবর পর্যন্ত মাছ বড় হতে পারবে। শীতের আগে হাওরে পানি কমে গেলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
হুয়াং হো বনাম হাওর
প্রাচীন চীনে প্রায়ই হুয়াং হো নদী ছাপিয়ে উঠে সবকিছু বন্যায় ভাসিয়ে দিত বলে এর নাম হয়েছিল ‘চীনের দুঃখ’। ২৬ বার এই নদীর গতিপথ বদল হয়েছে। প্রতিবারই চীনের জনগণের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা। কিন্তু ১৯৪৯ সালে সেখানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চীন সরকার হুয়াং হো নদীর উজানের দিকে এবং মধ্য এলাকা বরাবর মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন কতগুলো জল সংরক্ষণ প্রকল্প নির্মাণ করে এবং ভাটির দিকে নদীর পাড়ের বেড়িবাঁধগুলো আরও মজবুত করে এবং নদীর তীরবর্তী জনসাধারণের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়। বাংলাদেশের হাওরের মানুষও শত শত বছর ধরে বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। কিন্তু কোনো সরকারই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। ফল যে হাওর মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান সম্বল, সেই হাওরই তাঁদের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.