বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিতর্ক

বিএনপির ভিশন ২০৩০-এর খসড়ায় ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ’-এর প্রস্তাবসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিজেদের মধ্যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন দলটির নেতারা। শুধু তাই নয়, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্থায়ী কমিটির বাইরের দু’জনের উপস্থিতি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন কোনো কোনো নেতা। সূত্র জানায়, সোমবার রাতে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে মূলত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব নিয়েই বিরোধিতা শুরু হয়। খালেদা জিয়াও একপর্যায়ে বলেন, এই ভিশন ২০৩০-এর সঙ্গে আরও ৩-৪ জন রাজনীতিবিদ যুক্ত করা উচিত ছিল। দীর্ঘ আলোচনার পরও এ ইস্যুতে কোনো সমাধান না হওয়ায় গভীর রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠক মুলতবি করা হয়। কিন্তু মঙ্গলবার সকালের মুলতবি বৈঠকে রাতে অংশ নেয়া নেতাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন না। সূত্র জানায়, রাতের বৈঠকের শুরুতে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য উপস্থিত নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের এ বৈঠকে দু’জন বিশেষজ্ঞ অংশ নেবেন। যারা ভিশন ২০৩০ তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা হলেন : অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবউল্লাহ ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ। ওই সময় স্থায়ী কমিটির অপর এক সদস্য বলে ওঠেন,
‘হ্যাঁ, ওনারা তো আমাদের শেখাবেন, প্রশিক্ষণ দেবেন। তাহলে ডাকেন। আপনারা, ভিশন ২০৩০ তিন মাস ধরে তৈরি করেছেন। আমরা তো মূর্খ, আমাদের বোঝার জন্য তিন দিনও সময় দেবেন না, তা কী করে হয়? আপনারাই যদি সব সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বলে দেন, যে ভিশন ২০৩০ কণ্ঠভোটে পাস হয়ে গেছে। এখানে আমাদের মতামতের প্রয়োজন কী?’ বৈঠক পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দলের ওই প্রভাবশালী নেতা বলেন, ‘আপনারা যদি এভাবে বলেন, তাহলে তো দলের চেয়ারপারসন বিব্রত হন।’ জবাবে ওই সদস্য বলেন, ‘ভিশন ২০৩০ এটি কার? অবশ্যই বিএনপির। এটি বিএনপির ফোরামে আলোচনা হতে হবে। কিন্তু বিষয়টি গত বছরের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে ঘোষণা দেয়া হলেও এ নিয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা খালেদা জিয়াকে খুশি করতে গিয়ে দেশের ক্ষতি করতে পারব না।’ এরই মধ্যে আমন্ত্রিত ওই দু’জন বৈঠকে অংশ নেন। তারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিষয়টি ব্যাখ্যা দেন। ভিশন ২০৩০-এর ৬ নম্বর ইস্যুটি ছিল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদের প্রস্তাব। এ প্রস্তাব উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বিতর্ক। এ সময় স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ও আইনজীবী নেতা শুরু করার পর এতে প্রায় সবাই অংশ নেন। একপর্যায়ে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। শুরুতে ওই আইনজীবী নেতা বলেন, ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এটা সাংবিধানিক। এটা তো আমাদের (আইনজীবী) কাজ। এ নিয়ে যারা কাজ করছ, তোমরা কী বোঝ? এক কেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কোনোভাবে হতে পারে না। যে দেশে একটি সরকারই সামলানো যায় না, সেখানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হয় কী করে?’ এরপর স্থায়ী কমিটির অপর এক সদস্য বলে ওঠেন, ‘না, না ম্যাডাম এটা হবে না। এটা আমাদের নেতা জিয়াউর রহমানের আদর্শের সঙ্গে যায় না। জিয়াউর রহমান চেয়েছেন অখণ্ড বাংলাদেশ। এটা আমাদের প্রস্তাব হতে পারে না। এ প্রস্তাব ভারত বা অন্য কোনো দেশের।’ এ সময় খালেদা জিয়া ওই নেতাকে বলেন, ‘আস্তে আস্তে বল। বুঝিয়ে বল।’ জবাবে ওই নেতা বলেন, ‘দেশটাকে ভাগ করা যাবে না। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট করলে ইন্ডিয়ার মতো ভাগ হবে। এটা ঠিক হবে না। পরে সবাই বলবে,
আমাদের সভা থেকেই দেশ ভাগের প্রস্তাব এসেছে।’ তাই তিনি বলছেন, এটা হবে না, যান। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে দেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করতে হবে। প্রতিটি প্রদেশের একজন করে মুখ্যমন্ত্রীসহ আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো থাকবে। দশটা প্রদেশে ভাগ হলে একটি প্রদেশ যদি ইন্ডিয়া নিয়ে যায় তাহলে কী করার আছে। জিয়াউর রহমানের দর্শন হচ্ছে অখণ্ডতা। এটাই শক্তি। না ম্যাডাম, এটা হবে না, হতে পারে না। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য (আইনজীবী) বলেন, এটা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে হতে পারে। সেখানে ফেডারেল সরকার রয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বাংলাদেশে হতে পারে না। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া বলেন, এই ভিশন ২০৩০ তৈরির সঙ্গে আরও ৩-৪ জন রাজনীতিবিদের যুক্ত থাকা উচিত ছিল। স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা বলেন, ‘আমরা যদি জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব করি, তাহলে একপর্যায়ে দেশের বিভিন্ন বিভাগ বা বড় জেলাগুলো রাজ্যের দাবি ওঠবে। তখন সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’ ওই নেতা আরও বলেন, ‘আপনারা বলতে চাচ্ছেন, জাতীয় সংসদের বর্তমান চেহারা ঠিক রেখেই উচ্চকক্ষ ও নিন্মকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা হবে। সে ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের যদি ক্ষমতা না থাকে তাহলে এটা করে লাভ কী?
আবার ক্ষমতা দিলে নিন্মকক্ষের সিদ্ধান্ত উচ্চকক্ষে আটকে যাবে। সেখানে কাজে ব্যাঘাত ঘটবে।’ সে ক্ষেত্রে তিনি বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘দ্বিকক্ষ না করে জাতীয় সংসদে প্রয়োজনে নারী কোটার মতো আরও আসন বাড়ানো হোক। সেখানে এসব সুশীল-বুদ্ধিজীবীদের স্থান দেয়া হোক। এ ছাড়া পরামর্শক হিসেবে কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হলে সরকারে গেলে তাদের নেয়ার তো সুযোগ রয়েছে।’ খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে ওই নেতা আরও বলেন, দেশের মানুষ এসব ‘ভিশন’ বোঝে না। তারা চায় সুখে-শান্তিতে থাকতে। এ ভিশন বাস্তবায়ন করতে হলে জাতীয় সংসদের ২০১টি আসনের প্রয়োজন। যা করলে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যাবে, সেটা করতে হবে। স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য প্রায় একই সুরে যুগান্তরকে বলেন, স্থায়ী কমিটির এ বৈঠকটি ছিল বেশ স্মরণীয়। এমন প্রাণবন্ত বৈঠক এর আগে কবে হয়েছে, তা তাদের জানা নেই। তাদের মতে, স্থায়ী কমিটির বৈঠক এমনই হওয়া উচিত। বিষয়টিকে নেতিবাচক নেয়ার কোনো অবকাশ নেই। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এমন যৌক্তিক তর্কবিতর্ক থাকা উচিত। ম্যাডামও এ আলোচনায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, কয়েকজন নেতা বৈঠকে বলেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণমাধ্যমে আমাদের জানতে হয়।

No comments

Powered by Blogger.