মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলের কৃষকদের কলাচাষে অভাব জয়

মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের পদ্মার দুর্গম চরাঞ্চলে কৃষকরা গড়ে তুলেছেন কলাবাগান। ফি বছর নদী ভাঙন আর ফসলহানী ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। বালু মাটিতে বাদাম, গম, কালাই ছাড়া লাভজনক ফসলাদী কল্পনা করতে পারতো না তারা। তাই চরাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষকেই তাড়িয়ে বেড়াতো অভাব। সেই বালুমাটিতে ফসল ঘাটতি পূরণ করে রীতিমতো ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন এখানকার কৃষকরা। সুতালড়ী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক সাইদ (৫৫)। দশ বছর বিদেশ থেকে দেশের মাটির টানে ফিরে এসে দীর্ঘদিন বেকার ছিলের। তখন তার মাথায় আসে সৌদি আরবে পাথর ও বালুর মাটির মধ্যে সফলভাবে বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়, আর বাংলাদেশের মাটি তো সোনার চেয়ে খাটি। ইচ্ছা করলেই যে কোন ফসল চাষ করা যাবে। তাই তিনি কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসার পেছনে না ঘুরে কলা চাষের কাজে মনোনিবেশ করেন। পদ্মার চরের ৫০ শতক জমিতে শুরু করেন কলা বাগান। প্রথমে শ’খানেক স্থানীয় জাতের সবরি কলার চারা সংগ্রহ করে রোপণ করেন তিনি। তাতে ভালো ফলন পান। উৎসাহিত হয়ে তিনি কলার বাগানকে সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৫০০টি সবরি ও কবরি দুটি জাতের কলার চারা রোপণ করেন তিনি। কিন্তু রোগ ও বন্যার পানির কারণে তেমন লাভবান হতে পারেননি।
তবে হাল ছাড়ার পাত্র নন কৃষক কৃষক সাইদ। তিনি ২০১৬ সালে আবার এক হাজার কলার চারা রোপণ করেন। এবার তিনি সফলতা লাভ করেন। চলতি বছরে তিনি কলা বাগানে ৫ বিঘা (৩৩ শতক ১ বিঘা) জমিতে দুই সহ¯্রাধীক স্থানীয় জাতের সবরি, কবরি, মদনা, জাতি কলার রোপণ করেন। বালু চরে এখন সবুজ কলাবাগান দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। তার দেখাদেখি চরাঞ্চলের অন্য কৃষকরাও কলা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। চরাঞ্চলে বিশেষ করে হালুয়াঘাট, মেহেন্দেীপুর, নটাখোলা, হরিহরদিয়া চরে প্রায় ৬০০ একর পতিত জমি রয়েছে। এসব পতিত জমিতে এলাকার কৃষকরা তাই কলা চাষের উদ্যোগ নেন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষক সাইদ বলেন, ‘আমার কলাচাষ দেখে এলাকার অনেক কৃষক আমার কাছ থেকে কলা চাষের বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘১০০ কলা গাছ চাষ করতে কলা বিক্রি পর্যন্ত খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো। কলা বিক্রি থেকে আয় হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। আগে আমি অন্যেও কাজ করতাম আর এখন আমার কলা বাগানে ৮/১০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন।’ ইতোমধ্যে বসন্তপুর গ্রামের বেল্লাল হোসেন, পাটগ্রাম চরের মো: শহিদুল, হরিহরদিয়া গ্রামের রাসেল এবং নটাখোলা গ্রামের ফয়সাল, লিটন, রবিউল এসব ছাত্র ও যুবক কলাচাষের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নটাখোলা গ্রামের যুবক ফয়সাল হোসেন ৭ বিঘা জমিতে দুই সহস্রাধিক স্থানীয় জাতের কলা চাষ করেছেন। চাষীরা কলার চারা ঝিটকা, ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন। ক্রয় থেকে শুরু করে পরিবহন খরচসহ চারাপ্রতি মূল্য খরচ পড়ে ১৫-২০ টাকা। কলা চাষ সম্পর্কে চরাঞ্চলের কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্থানীয় কৃষি অফিস, বেসরকারী কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকসহ বিভিন্ন সংস্থা সহযোগিতা করছে। কলাচাষীদের নিয়ে মতবিনিময় সভা, আলোচনা সভা,
অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করছে। এই প্রসঙ্গে নটাখোলা গ্রামের যুবক কৃষক ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘কলাচাষে আমাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে আমাদের অভিজ্ঞ কৃষকের কাছে যেতে হয়। কলাচাষের বিষয়ে আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে চাই।’ হরিহরদিয়া গ্রামের কলাচাষী রাসেল বলেন, অর্থ সংকটের কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছু করতে পারছি না। স্বল্প সুদে সরকারি বেসরকারি যে কোনো ব্যাংক, বীমা, এনজিও বা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেলে আমার কৃষি খামার প্রসারিত করতে পারবো। বেসরকারী কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা বারসিকের হরিরামপুর আঞ্চলিক কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন সাহা জানান, কৃষকরা কলা বাগানের সাথে সাথী ফসল হিসেবে করলা, ঝিংগা, শশা, মিষ্টি কুমড়া চাষ করছেন। অনেক কৃষক কলা বাগানের সাথে পেঁপের বাগানও করেছেন। এতে কৃষকরা দুইভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে অন্যান্য ফসলের মতো কলাচাষে নানান রোগ দেখা দেয়। এসব রোগ নিরাময়ে স্থানীয় কৃষি অফিস এবং বারসিকের মাঠকর্মীরা কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছেন। মানিকগঞ্জ জেলা উপসহকারী কৃিষ কর্মকর্তা গুরুদাস সরকার জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে দেশীয় সবরি, সাগর ও আনাজ কলার চাষ করেছেন কয়েক হাজার কৃষক। তিনি আরো জানান, চরাঞ্চলের বালু মাচিতে সাধারণত তেমন লাভজনক ফসলাদী হয় না। তাই এখানকার কৃষকরা অল্প খরচে অধিক আয়ের কারনেই দিন দিন কলা চাষের দিকে ঝুঁকছে।

No comments

Powered by Blogger.