বুদ্ধের বাণী আজও কত প্রাসঙ্গিক

আজ শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। ২৫৬১ বুদ্ধাব্দ শুরু হল। দিনটি মানব বিশ্বের ইতিহাসে এক পরম পবিত্রতম তিথি। এ দিনেই মহামানব গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে কপিলাবস্তুর নিকটবর্তী লুম্বিনী উদ্যানে। ছয় বছর কঠোর তপস্যার পর তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে বুদ্ধত্ব লাভ করেন গয়ার বোধিবৃক্ষ মূলে। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধর্ম প্রচারের পর ৮০ বছর বয়সে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন (খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে) কুশিনগরের মল্ল রাজাদের শালবনে। বুদ্ধ জীবনের মহান এ তিনটি প্রধান ঘটনাই মানব বিশ্বের ইতিহাসে ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ নামে অভিহিত। এদিন সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধরা এবং মানবতাবাদী দার্শনিক চিন্তাবিদরা বুদ্ধের জীবনদর্শনকে গভীরভাবে অনুধাবন করেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রমণ ও গৃহীরা শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাচর্চা করেন। বিশ্বের বৌদ্ধরা এ দিনটি অত্যন্ত ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপন করেন। আজ এ শুভ তিথিতে আমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীকে জানাই বুদ্ধ পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মহামানব বুদ্ধ ছিলেন অহিংস, ন্যায় ও সাম্যনীতির এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। তার প্রতিটি বাণী ছিল অহিংস ও সাম্যনীতির পক্ষে। তার অনুশাসনও ছিল আত্মজয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পক্ষে। তাই তার ধর্মে কোনো অলৌকিকত্ব নেই, নেই কোনো ঈশ্বরস্তুতি কিংবা ভক্তিবাদ। আছে শুধু বুদ্ধি ও বিবেকশাণিত যুক্তি ও আত্মজিজ্ঞাসা। আছে নিজকে দেখার,
জানার ও বিচার করার পরম শিক্ষা। এটাই বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের মূল শিক্ষা। গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবকালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল রাজতান্ত্রিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজতান্ত্রিক পরিবেশে বিভিন্ন পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যেমন- একনায়কতন্ত্র, বংশগত রাজতন্ত্র, মনোনীত রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি। বুদ্ধযুগে ভারতবর্ষের ১৬টি স্বতন্ত্র রাজ্যর পরিচয়ও পাওয়া যায়, যেখানে ওইসব রাজ্যে এসব শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। বুদ্ধ ছিলেন একজন রাজপুত্র। সেই সূত্রে পার্শ্ববর্তী সব রাষ্ট্রের শাসকদের মধ্যে তার অনেক কদর ছিল। বিশেষত ভারতবর্ষের রাজারা যখন আপন আপন রাজ্য বিস্তারের আশায় উন্মুখ, ঠিক তেমন এক সময়ে যুবরাজ সিদ্ধার্থ রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করলেন, ত্যাগ করলেন তার রাজ্যসুখ ও বিশাল সাম্রাজ্যও। ওই সময়ে রাজা, শ্রেষ্ঠী তথা ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কিংবা তাদের উত্তরসূরিরা যেখানে ধন-জন, মান ও রাজ্য বিস্তারে, এমনকি ভোগ-বিলাসে মত্ত- সে সময় রাজকুমারের গৃহত্যাগ সত্যিই এক অভাবনীয় ঘটনা। বিশেষ করে জাত-পাত এবং বর্ণবৈষম্যপূর্ণ সমাজে এ ধরনের ঘটনা সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব ও অলৌকিক। বলতে গেলে সে সময়কার মানবতা ও মূল্যবোধহীন অসচেতন সমাজে রাজ্য ত্যাগ ছিল এক অকল্পনীয় ঘটনাও। তাই রাজকুমারের সংসার ত্যাগের পরপরই সব রাজার মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল রাজকুমার সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের বার্তাটি। সে সময় ভারতবর্ষের রাজারা রাজকুমার সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগের কথা শুনে প্রথমে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। দীর্ঘকাল পর তিনি যখন বুদ্ধত্ব লাভ করে এসে ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে মানবতা ও সর্বজনীন সাম্য ও অহিংসার বাণী প্রচার করেন এবং আর্ত-পীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখনই রাজন্যবর্গের চৈতন্যে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হল। পরে তারাও বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। কিন্তু এক সময় আবার তারা বুদ্ধের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন- যখন বুদ্ধ সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য তার দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন। এতে বুদ্ধ সামান্যও বিচলিত হননি। কারণ তার দর্শন ছিল মানুষের নিরঙ্কুশ অধিকার, সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ এবং সর্বপ্রাণীর নিরাপদ বিশ্ব সৃষ্টি করা। তিনি শ্রেণী চেতনায় যেমন আকৃষ্ট হননি, তেমনি প্রচলিত জাতিভেদ প্রথায়ও আবদ্ধ হননি। তার মতে কোনো মানুষেই জন্মের কারণে উঁচু-নীচু শ্রেণী বিভাজনে আবদ্ধ হতে পারেন না। মানুষের মর্যাদা চিহ্নিত হবে কর্মে ও যোগ্যতায়; জন্ম বা বংশ মর্যাদা দিয়ে নয়।
সে সময় এ ধরনের বাণী প্রচার করা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। একমাত্র তার পক্ষেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। ধর্ম প্রচারের প্রথম থেকেই তিনি এভাবে মানুষের মূল্যবোধকে জাগ্রত করার প্রচেষ্টায় নিবেদিত হলেন। বুদ্ধ বসলসূত্রে বলেছেন, ‘জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, কেউ অব্রাহ্মণও হয় না; কর্মের দ্বারাই ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ হয়।’ এ বাণীর মাধ্যমেই তিনি তার ধর্মানুরাগী শিষ্যদের কাছে সৃষ্টি করলেন স্বাধীন চিন্তা-চেতনার ভিত্তিভূমি। তিনি মানুষের নিজস্ব চিন্তা ও স্বাধীনতার দ্বার খুলে দিলেন সেদিনের কঠোর রুদ্ধদ্বার সমাজে। শুধু তাই নয়, এমনকি স্বাধীনভাবে নিজেকে উপলব্ধি করা এবং মুক্তচিত্তে তাদের স্ব স্ব মতপ্রকাশ করতেও মানুষকে উজ্জীবিত করলেন। আবার এটাও বলে দিলেন, ব্যক্তিস্বাধীনতা যেন স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত না হয় এবং প্রত্যেক মানুষ যেন আপন বিবেকের বিবেচনায় নিয়ন্ত্রিত থাকে। বৌদ্ধ পরিভাষায় একেই বলা হয় ‘গৃহী বিনয়’। এ নীতিতে একজন সাধারণ মানুষ সমাজের যে কোনো জায়গায় যেমন সদস্য হতে পারবেন এবং সবার সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক রাখতে পারবেন; তেমনি পারবেন এর মাধ্যমে বেঁচে থাকার এক অপূর্ব জীবন শিক্ষাও। তিনি গৃহী বিনয়ের মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের, বিশেষ করে ক্ষমতাধর শাসক-প্রশাসক, রাজা, শ্রেষ্ঠী, ধনী, এমনকি রাজভৃত্য, রাজ দাস-দাসী ও রাজ কর্মচারীর জীবন কীভাবে পরিচালিত হতে পারে তাও উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, সর্বশ্রেণীর গৃহীর জন্য বুদ্ধ প্রবর্তন করেছেন পঞ্চশীল নীতি; যেখানে বলা আছে, প্রাণী হত্যা বা নিধন না করা, পরদ্রব্য অপহরণ বা চৌর্যবৃত্তি না করা, অবৈধ এবং কোনো ধরনের অসামাজিক যৌনাচারে লিপ্ত না থাকা, কোনো প্রকারের অসত্য ও মিথ্যা কথা বা বাক্য না বলা এবং যে কোনো নেশাপান থেকে বিরত থাকা। মঙ্গলসূত্রে তিনি আরও বলেছেন, অজ্ঞানী বা মূর্খ লোকের সংস্পর্শে না থাকা, জ্ঞানী বা পণ্ডিত লোকের সান্নিধ্যে থাকা এবং সম্মানীয় ও পূজনীয় ব্যক্তিদের পূজা করাই উত্তম মঙ্গল। একই সূত্রে তিনি অন্যত্র উল্লেখ করেছেন- গৌরবনীয় ব্যক্তির গৌরব করা,
তাদের প্রতি বিনয় প্রদর্শন করা, প্রাপ্ত বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকা, উপকারীর উপকার স্বীকার করা উত্তম মঙ্গল কর্ম। এ ছাড়া মাতা-পিতার সেবা করা, স্ত্রী-পুত্রের ভরণ-পোষণ ও উপকার করা, নিষ্পাপ ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করা ইত্যাদি গৃহী জীবনের উত্তম কর্ম। আজ সমগ্র বিশ্বে সামাজিক শান্তি-সম্প্রীতি ও কল্যাণময় জীবনযাপনের প্রধান অন্তরায় বা বাধা হল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক ও বৈশ্বিক ত্রাস সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত মানুষ কেন সন্ত্রাসী হবে। এর জন্য কি শুধু অর্থনৈতিক অবস্থাই দায়ী, নাকি আমাদের চারিত্রিক অধঃপতনও। বর্তমান পত্রপত্রিকার দিকে দৃষ্টি দিলেই প্রথমে যা অনায়াসে ধরা পড়ে তা হল আমাদের চারিত্রিক অধঃপতনের কথা। সব শ্রেণীর মধ্যে এর প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। নৈতিক ও মূল্যবোধের আজ এত অবক্ষয় যে তা পৃথিবীর সব স্তরকে দূষণ করে ফেলেছে। এজন্য সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের সব জায়গা যেন আজ কলুষিত ও ক্ষতবিক্ষত। তাই বুদ্ধ আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও আগে সুস্থ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যক্তি চরিত্র শুদ্ধিতার প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তার এ শিক্ষার গুরুত্ব তদানীন্তন সমাজের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। তখন বুদ্ধের এ শিক্ষা প্রাচীন ভারতবর্ষের জনজীবনের সব স্তরে বিস্তৃত হয়েছিল। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা, সচেতনতা ও সদিচ্ছা ছাড়া কখনই কারও একার পক্ষে সুন্দর, সুস্থ, সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। একমাত্র আত্মচরিত্র সংশোধন এবং সচেতনভাবে নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই এটি সম্ভব এবং এর মাধ্যমেই আশা করা যায় সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
আমাদের জাতীয় জীবনের নানা ঘটনা প্রবাহে এবং আনুপূর্বিক বিচারে এ হতাশা জাগা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও মনে করি, শুভদিনের সম্ভাবনা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। মেঘের আবরণে সূর্যের আলো যেমন অন্ধকারেই ফিরে আসে, তেমনি ঘাত-প্রতিঘাত ও বাধা-বিপত্তির মধ্যেও আমাদের দীর্ঘ প্রত্যাশিত সেই শান্তি ও নিরাপদ আশ্রয় একদিন আসবেই। এর জন্য চাই প্রকৃত শিক্ষা, সুশিক্ষা, স্বশিক্ষা এবং প্রকৃত ধর্মবোধে জাগ্রত ও উদ্বুদ্ধ হওয়া। এতে জাতি, সম্প্রদায়, দেশ ও বিশ্ব উপকৃত হবে। এর জন্য প্রয়োজন দল, মত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্য ও আত্মীয়তাবোধ। আরও প্রয়োজন বিজ্ঞানমনস্কতা, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক চেতনার উদ্বোধন এবং নাগরিকদের স্বাধীনতা ও যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। সর্বোপরি ত্যাগে, উদারতায় ও মহত্ত্বে উন্নত জীবন এবং সব ধরনের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতামুক্ত সমাজ এবং বিশ্বজনীন শান্তি ও সুখময় জীবন। চলুন আজ আমরা সেই দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করি। সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু- জগতের সকল জীব সুখী হোক। বুদ্ধ পূর্ণিমা সফল হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক, বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
skbaruadu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.