আদালতের সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের বাকবিতণ্ডা

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানির দ্বিতীয় দিন আদালতের সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের বাকবিতণ্ডা হয়েছে। শুনানি দু’সপ্তাহের জন্য মুলতবি এবং সাত বিচারপতির বেঞ্চে শুনানির আবেদন নাকচ করায় এ পরিস্থিতির অবতারণা হয়। এ সময় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম বলেছেন, এভাবে শুনানি চালিয়ে গেলে আমি নিজেকে এ মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেব। সাত বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি না করলে আমি অনাস্থা জানাব। এরপরও আদালত শুনানি চালিয়ে যান। আগামী ২১ মে এ বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। এ বেঞ্চের অপর সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হুসেইন হায়দার। সকালে শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল দুটি আবেদন দাখিল করেন। এর একটি আবেদনে বলা হয়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠের দেয়া রায়ে বলা হয়েছে, ‘অভিজ্ঞতা বলছে, বিপুলসংখ্যক এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড রয়েছে।’ কিন্তু এ ব্যাপারে রায়ে বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি।
এটা রাষ্ট্রের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। আবেদনে যেসব এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড রয়েছে তাদের নামসহ বিস্তারিত তথ্য দিতে হাইকোর্টের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়। অপর আবেদনে বলা হয়, যেহেতু ষোড়শ সংশোধনীর সঙ্গে সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত, সেক্ষেত্রে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আজকে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এ বিষয়ে শুনানিতে নেই। এ অবস্থায় যাতে করে ওই দুই বিচারপতিও এতে অংশ নিতে পারেন, সেজন্য শুনানি দু’সপ্তাহ মুলতবি করার আবেদন জানানো হয়। এ অবস্থায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে বিষয়টি দেখা যাবে উল্লেখ করে আদালত শুনানি চলমান রাখতে বলেন। শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি জাতীয় সংসদের হাতে নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকা উচিত তা দ্রুত নির্ধারণ হওয়া দরকার। এ বিষয়ে বর্তমানে দেশে কোনো আইন নেই। প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। এক্ষেত্রে কোনো শূন্যতা থাকতে পারে না। এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগে এখন বিচারপতির সংখ্যা সাতজন। কিন্তু শুনছেন ৫ জন। এভাবে বিচার চললে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হব। তিনি বলেন, আপনারা গতকাল (সোমবার) বলেছেন, সবাই শুনবেন। আজ তা শুনছেন না। সাতজনকে শুনতে বলায় ভুল কোথায়? প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি আদালতকে খাটো করে (আন্ডার মাইন্ড) দেখছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তা করছি না।
আমাদের আবেদন, হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, বৈরী কিছু থাকলে সেটা আমরা দেখব। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায়ে অনেক কথা আছে। বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, এখনও তো মামলা শুনলামই না। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি শুনানি বিলম্ব করছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই বিচার বিভাগ (হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে) এভাবে কথা বলতে পারে না। আমি অসহায়। এভাবে শুনানি অব্যাহত রাখলে ন্যায়বিচার হবে না। আমি শুনানি থেকে নিজেকে উইড্রো (প্রত্যাহার) করে নেব। শুনানিতে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করবেন না। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি আদালতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে আপনি নিজেই বিপদে পড়বেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন (থ্রেট করছেন)? গতকাল বলেছেন যে সবাই শুনবেন। কিন্তু তাতো দেখছি না। আমরা তো আদালতকে সহযোগিতা করতে চাই। প্রধান বিচারপতি বলেন, হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন করতে সমস্যা কোথায়? আপনি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করুন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি বলেছিলেন যে ৭ জনই শুনবেন। কিন্তু এখন তা শুনছেন না। আমি তো বলেছি মে মাসেই শুনানি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে হলে তো আমি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হব। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি পীড়াপীড়ি করছেন কেন? এর পরও প্রধান বিচারপতি রায় উপস্থাপন করতে বললে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায় উপস্থাপন করব। তবে আমাকে সময় দিতে হবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা আগে বলেছিলাম লিখিত যুক্তিতর্ক প্রস্তুত করে তা দাখিল করতে। আপনার দফতরে ১৫৫ জন আইন কর্মকর্তা আছেন। এটা প্রস্তুত করতে এত সময় লাগবে কেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছি। এ সময় দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। আশা করছি, এ সময়ের মধ্যে উনারা (বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) ফিরে আসবেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি হাইকোর্টে শুনানি করেছেন। আপনার সব মনে থাকার কথা। বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, আপনি আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা। তাই মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বলা ঠিক হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি নিরুপায় হয়ে বলেছি। আপনারা যখন ৫ জন শুনবেন বলেছেন তখন এটা বলেছি। এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে পড়া শুরু করেন। হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন শেষ হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, গতকাল (সোমবার) সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান উপস্থিত ছিলেন। আজ ড. কামাল হোসেন,
এমআই ফারুকী আছেন। এ পর্যায়ে ড. কামাল হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, আমি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করেছি। এ সময় ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ড. আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে লিখিত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আশা করি বাকি যারা আছেন তারাও দাখিল করবেন। এরপর প্রথম দফায় প্রধান বিচারপতি আগামী রোববার (১৪ এপ্রিল) পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনারা ন্যায়বিচারের স্বার্থে অন্যান্য মামলায় সব পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। এ মামলায় সেটা করছেন না কেন? দুই সপ্তাহ সময় দেয়ার আবেদন করছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখানে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। সুপ্রিমকোর্ট এ সংবিধানের অভিভাবক। আমাদেরকে একদিকে যেতে হবে। এরপর আদালত আগামী ২১ মে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, করজোড়ে বলছি, সবাইকে নিয়ে শুনানি করুন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, সবাইকে নিয়ে শুনতে হবে এমন শর্ত দেয়া যায় না। একজন বিচারপতি অসুস্থ থাকতে পারেন। একজন বিদেশে থাকতে পারেন। একজন তো জুলাইয়ে অবসরে যাবেন। কেউ জুলাই পর্যন্ত অসুস্থ থাকতে পারেন। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই প্রধান বিচারপতিকে আদালত চালাতে হবে। শর্ত দেবেন না। এ সময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, মি. অ্যাটর্নি জেনারেল আপনি আবেদন (প্রেয়ার) করতে পারেন, কিন্তু আরোপ (ইম্পোজ) করতে পারেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সবাইকে যুক্ত করতে চাচ্ছি।
অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্রিফিং : শুনানি শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগের সব বিচারপতি যাতে শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন সে জন্য প্রথম থেকেই এ বিষয়ে জোর দিচ্ছি। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাও যাতে শুনানিতে অংশ নিতে পারেন সে জন্য সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু দেননি। আদালতকে বলেছি, আপনারা সবাই মিলে যদি এ মামলার শুনানি না করেন, সে ক্ষেত্রে আমি হয়তো নিজেকে এ মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেব। অনাস্থার ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অনাস্থার কথা সেভাবে আসেনি। আমি বলেছি, প্রধান বিচারপতি গত তারিখে বলেছেন সব বিচারপতিকে নিয়ে এ মামলা শুনবেন। আজকে একপর্যায়ে বললেন সবাইকে না নিয়ে পাঁচজনকে নিয়েই শুনব। তখন আমি বলেছি, আপনারা যদি আপনাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন, তাহলে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হব। অন্যদিকে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানিয়েছেন, ‘অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শুনানি চলমান রয়েছে। দেশে যেহেতু এ বিষয়ে কোনো আইন নেই, সে জন্য দ্রুত এ মামলার শুনানি শেষ হওয়া দরকার।’ ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। এ আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে গত বছর ৫ মে ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। তিন বিচারকের মধ্যে দু’জন ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন এবং একজন রিট আবেদনটি খারিজ করেন। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গত বছরের ২৮ নভেম্বর আপিল দায়ের করেন।

No comments

Powered by Blogger.