আতঙ্কের নাম ‘মহিলা সিট’!

কয়েকদিন আগের কথা। বিআরটিসি বাসে উঠেছি। প্রবেশ দরজার পাশেই সংরক্ষিত আসন। দেখি সব খালি। গিয়ে যেই বসলাম, অমনি দাঁড়ানো কিছু যাত্রী হইহই করে উঠল- ‘এই ভাই উঠে যান। উঠে যান। ওটা মহিলা সিট। বসলেই কিন্তু জেল-জরিমানা। দেখেন না, খালি পড়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছি, তারপরও আমরা কেউ বসিনি।’ মানুষের এমন আচমকা প্রতিক্রিয়ায় হতবাক। বুঝলাম, মাত্র আগের দিন সড়ক পরিবহন আইনটি মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। এতে মহিলা সিটে বসলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা ১ মাস জেল বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ভয়-আতঙ্ক কিংবা সচেতনতা যাই হোক; মানুষের সতর্কতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। দেশে শত শত আইন আছে। সিংহভাগ কিতাবের গরু, বাস্তবে নেই। আর এই আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়া দূরে থাক, সংসদে এখনও পাসই হয়নি। সদ্য কেবল মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে। তারপর ২৪ ঘণ্টাও পেরোয়নি। তার আগেই প্রয়োগ শুরু। বিরল হলেও খুবই ইতিবাচক একটা চিত্র। তবে নেতিবাচকতা হল, ফিরে দেখি সব মহিলা ওই বাসের সাধারণ সিটে বসে আছে। নিজেদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো ফাঁকা রেখে সবাই সাধারণ সিট দখল করে বসে আছে। অবশ্য এই দৃশ্য নতুন নয়। এর পেছনে হয়তো কিছু যুক্তি আছে। যেমন-১. সাধারণ সিটে মহিলারা বসতে পারবে না, এমন বিধান কোথাও নেই। এমনতো নয় যে, সাধারণ সিটগুলো কেবল পুরুষ সিট। মহিলারা সংসদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি, চাইলে সাধারণ আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। সরকারি চাকরিতে মহিলা কোটার পাশাপাশি সাধারণ কোটায়ও চাকরি পেতে পারে। একইভাবে বাসেও সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি সাধারণ আসনও দখল করতে পারবে। এমনকি মহিলা সিটগুলো ফাঁকা রেখেই সাধারণ আসনে বসে পুরুষ জাতিকে বাদুড় ঝোলার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে পারে। তাতে আইনগত বাধা নেই।
২. কর্মজীবী বা ছাত্রী ছাড়া সিংহভাগ মহিলার সঙ্গে স্বামী, ভাই, ছেলে, বন্ধু- কেউ না কেউ থাকে। মহিলা সিটে বসলে পাশে পুরুষ সঙ্গীটিকে বসানোর সুযোগ নেই। এই মুশকিলে ‘সাধারণ সিট’ই একমাত্র সমাধান। প্রকৃতপক্ষে বাসের সব সিটই মহিলা সিট। কোনো সিটই পুরুষ সিট নয়। কারণ দু’-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ সিটে বসা পুরুষটি পাশে মহিলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই সাধারণত আসন ছেড়ে দেয়। বাচ্চা, প্রতিবন্ধী বা মুরব্বিরাও সিংহভাগ পুরুষ যাত্রীদের কাছ থেকে এই সুবিধা বা সম্মানটা পায়। পুরুষ যে মহিলা সিটে বসে না, তা নয়। ফাঁকা পেলে বসে। কিন্তু মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী এলেই ছেড়ে দেয়। আইনের জোর নয়, লোকাচার বা সামাজিক প্রথার জোরেই নিয়মটা চলে আসছে। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। মাঝে মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। কিন্তু তা দিয়ে তো একটা সিস্টেমের গোটা চিত্র আঁকা যাবে না। সত্যি বলতে কী, সড়ক পরিবহন আইনের এই বিধানটিকে খুবই কঠোর, একপেশে এবং অসম্পূর্ণ বলতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায়, সংরক্ষিত আসন ফাঁকা থাকলেও বাদুড় ঝোলা অসুস্থ পুরুষ যাত্রীটিও ওই আসনে একটু বিশ্রাম বা আশ্রয় নিতে পারবে না। রাত যতই বাড়ে, বাসে ততই যাত্রী কমে। ভোরে বা ছুটির দিনেও যাত্রী কম থাকে। এ বিধানমতে ওই অবস্থায়ও কোনো পুরুষ যাত্রী (বয়োজ্যেষ্ঠ নয়) ওইসব সিটে বসতে পারবে না। বসলেই জেল-জরিমানা। শাস্তিটা তখনই কিছুটা সঙ্গত হতো; যদি মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী বা বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রী এসে সংরক্ষিত আসনে বসতে চাইল; কিন্তু সেখানে বসে থাকা পুরুষ যাত্রী গোঁ ধরে বসে রইল। বলার পরও আসন ছাড়ল না।
তখন নিয়মটি প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু শাস্তি যোগ হলে অতটা বাড়াবাড়ি মনে হতো না। কেবল ওই শাস্তি নয়, মহিলাদের (শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠ নয়) জন্য বাসে আলাদা সিট সংরক্ষণের বিধান কতটুকু সংবিধানসম্মত তা নিয়েও ভাববার অবকাশ আছে। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবে। ২৭ অনুচ্ছেদ জানাচ্ছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। ২৮ অনুচ্ছেদের ঘোষণা, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারবে না। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে। সংবিধানে নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কিভাবে বাসে ‘মহিলা সিটের’ বন্দোবস্ত হয়, তা ঠিক বোধগম্য নয়। কেবল একটা জায়গায় এই বৈষম্য অনুমোদিত। সেটা সরকারি চাকরি। বলা হয়েছে, কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে সুযোগের সমতার বিধান লঙ্ঘন করা যাবে। তার একটা হল, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো [অনু-২৯(৩)(ক)]। সে হিসেবে সরকারি চাকরিতে মেয়েদের কোটা তো আছেই। ‘বাসের সিট’ তো আর ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ নয় যে, এখানে মেয়েদের জন্য বিশেষ বিধান বা আসন সংরক্ষণ করতে হবে। কেউ কেউ হয়তো, অনুচ্ছেদ-২৮(৪)-এর দোহাই দেবেন। এখানে বলা হয়েছে, নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা যাবে। লক্ষ্য করুন, এই বিশেষ বিধানের উদ্দেশ্য কিন্তু ‘অগ্রগতি সাধন’। সংসদ, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন- সবখানে নারীদের জন্য ‘সংরক্ষিত আসন’ আছে। মানলাম তাতে নারীর অগ্রগতি আছে। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে বসতে দিলে এবং তাতে বসা পুরুষকে জেল-জরিমানা করলে কিভাবে নারীর অগ্রগতি হয়, তা বোধ-বুদ্ধির কোন যুক্তিতে পাওয়া গেল, ঠিক বোধগম্য নয়। অগ্রগতি একটি মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, অবকাঠামোগত কিংবা অর্থনৈতিক বিষয়।
আর বাসে সিট পাওয়া, না পাওয়া- একটা স্রেফ আরাম আয়েশজনিত বিষয়। এ দুটো জিনিস এক হয় কী করে? উল্টো বাসে নারীর জন্য আলাদা আসন সংরক্ষণ করলে নারীর শারীরিক সক্ষমতা বা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার সামর্থ্য বা আত্মবিশ্বাসকে কি প্রশ্নবিদ্ধ বা খাটো করা হয় না? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এ ধরনের বিধান সংবিধানসম্মত। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায়, শাস্তির পরিমাণটা কি খুব বেশি হয়ে গেল না? মহিলা সিটের বিষয়টি উপরে লেখা থাকে। কেউ যদি ভুলে মহিলা সিটে বসে পড়ে, তার জন্য তাকে যদি ১ মাস কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়, সেটা তো কার্যত ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’। এ অপরাধে ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। তাছাড়া, বৈষম্য দূর করতে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে মহিলাদের জন্যও (যারা সংরক্ষিত সিট ফাঁকা রেখে সাধারণ সিট দখল করেছে) একইরূপ শাস্তির বিধান থাকা উচিত ছিল। এক সেমিনারে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, নারী নির্যাতনের ৮০ শতাংশ মামলাই মিথ্যা। এটাও এখন প্রমাণিত, সময়ের আবর্তনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি কার্যত ‘পুরুষ নির্যাতন’ আইনে পরিণত হয়েছে। মহিলা সিটে জেল-জরিমানার বিধানটি যে পরিমাণ একতরফা ও কঠোর, তাতে এই আইনটিও আগামীতে ‘পুরুষ নির্যাতক’-এর ভূমিকায় দেখা দিত পারে। তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না।
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

No comments

Powered by Blogger.