হালদা নদীর গলার কাঁটা বাঁধ

চার বছর আগে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় হালদা নদীর ওপর তৈরি করা হয় একটি রাবার ড্যাম (বাঁধ)। এর এক বছর পর ভুজপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে হারুয়ালছড়ি খালে আরেকটি রাবার ড্যাম বানানো হয়। নদীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই খাল। দুটি রাবার ড্যামের কারণে এখন বছরে চার মাস হালদার উজানের অন্তত ৬ কিলোমিটার প্রায় পানিশূন্য অবস্থায় থাকে।
এতে নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতির পাশাপাশি হালদার জীববৈচিত্র্যও হুমকিতে পড়ছে বলে জানান গবেষকেরা। দুটি বাঁধের উদ্দেশ্য ছিল ভুজপুর থানাধীন অন্তত দেড় হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদের সময় পানির জোগান দেওয়া। বাঁধ দেওয়ার ফলে বোরো চাষাবাদে সেচ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় না ভুজপুরের কৃষকদের। ভুজপুরের ১৩টি চা-বাগানও এই বাঁধের সুফল পাচ্ছে। তবে বড় ক্ষতি হয়েছে নদীর। উজানে বাঁধের কারণে ভাটিতে পর্যাপ্ত পানি যেতে পারছে না। বাঁধের নিচে নদীর বড় একটি অংশ শুকিয়ে যাচ্ছে। হালদায় দিনে দিনে মাছের সংখ্যা ও মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ কমে যাওয়ার পেছনে এই বাঁধ দুটিকে দায়ী করছেন গবেষকেরা। বুয়েটের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক উম্মে কুলসুম নভেরা প্রথম আলোকে বলেন, হালদা দেশের অনন্য একটি নদী। এই নদী বাঁচানোর প্রধান শর্তই হচ্ছে, এতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। কিন্তু বাঁধের কারণে বছরে চার মাস সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সেই বাঁধটি সরিয়ে নিতে হবে। শুরুতে পুরোটা সরানো না গেলেও যতটা সম্ভব এর উচ্চতা কমিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বুয়েটের এক গবেষণায়ও বাঁধের বিরূপ প্রভাবের চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন গবেষক। ফটিকছড়ি উপজেলার পূর্ব ভুজপুর এলাকায় হালদা নদীর উজানে ২০১২ সালের মার্চ মাসে রাবার ড্যাম উদ্বোধন করা হয়।
পরের বছর হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের হারুয়ালছড়ি খালেও রাবারের বাঁধ দেওয়া হয়। বাঁধ দুটি নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি বিভাগ। গবেষকেরা বলছেন, বাঁধের কারণে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জলজ প্রাণের খাদ্য তৈরিতে অন্তরায় তৈরি করছে। গবেষণায় যুক্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, মৃগেল ও কাতলা মাছের খাদ্য হচ্ছে প্ল্যাঙ্কটন। আর রুই ও কালিবাউশের খাদ্য বেনথোস। বাঁধের কারণে নিচের অংশে প্রায় ২০ কিলোমিটার এ দুই খাদ্যের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। নদীর সত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত যেখানে প্রজননক্ষেত্র, সেখানে মাছের খাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। প্রজনন মৌসুমেও মাছকে খাদ্যের সংকটে ভুগতে হচ্ছে। মনজুরুল কিবরীয়া ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে পানি ও মাটির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। এতে দেখা যায়, বাঁধ কার্যকর থাকা অবস্থায় ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ভুজপুর, নারায়ণহাট, হারুয়ালছড়ি ও নাজিরহাট এলাকায় হালদা নদীর প্রতি ঘনমিটার পানিতে প্ল্যাঙ্কটন ও বেনথোসের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। অন্যদিকে এসব এলাকায় মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতি ঘনমিটার পানিতে ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখের মধ্যে প্ল্যাঙ্কটন ওঠানামা করে। উজানের বাঁধের প্রভাব পড়ে ভাটির পানিতেও। বাঁধ কার্যকর মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত) মাছের প্রজনন এলাকা রাউজান উপজেলার সত্তারঘাট থেকে হাটহাজারীর মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর প্রতি ঘনমিটার পানিতে প্ল্যাঙ্কটন পাওয়া গেছে ৫০ হাজার বা তার কিছু বেশি। অথচ একই এলাকায় মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি ঘনমিটার পানিতে দেড় লাখ পর্যন্ত প্ল্যাঙ্কটন পাওয়া গেছে। এই সময়ে প্রতি বর্গমিটার পানিতে বেনথোস পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ২০০। এ বিষয়ে হালদা নিয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাঁধ যখন কার্যকর থাকে, তখন নদীর নিচের অংশে অন্তত ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার এলাকা শুকিয়ে যায়। বাঁধের কারণে নদীর নিচের অংশে মাছের খাদ্য ক্ষুদ্র প্রাণি ও জলজ উদ্ভিদের ঘাটতি দেখা দেয়। এ কারণে মৃগেল ও কালিবাউশ মাছ কমে যাচ্ছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ভুজপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উজান থেকে নেমে আসা পানি বাঁধের ভেতরের অংশে আটকে রাখা হয়েছে। ১৭টি নালার মাধ্যমে এসব পানি চলে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বিলে। বাঁধের নিচের অংশের নদীর তলদেশের মাটি ফেটে গেছে। রাবার ড্যামটির প্রস্থ ১০০ মিটার, উচ্চতা সর্বোচ্চ সাড়ে চার মিটার। রাবারের এই বাঁধটি ফুলিয়ে পানি নামার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। অন্যদিকে হারুয়ালছড়ি খালে দেওয়া বাঁধটির দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার। আর উচ্চতা সাড়ে চার মিটার। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সেচের মৌসুমে বাঁধগুলো কার্যকর রাখা হয়। এর পর বাঁধ সরিয়ে নিলে হালদা পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। শুরুর দিকে সাড়ে তিন মিটার পর্যন্ত বাঁধ উঁচু করা হলেও এ বছর থেকে তা আড়াই মিটারে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে। ফটিকছড়ির উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লিটন দেবনাথ বলেন, এবার বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দেড় হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে। বাঁধ যখন ছিল না, তখন সব মিলিয়ে ৫০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা যেত। বাঁধের কারণে স্থানীয় কৃষকেরা খুশি। পূর্ব ভুজপুরের আমতলী এলাকার কৃষক তাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আগে যখন মেশিন দিয়ে পানি তুলে চাষাবাদ হতো, তখন সেচের জন্য কানিপ্রতি (৪০ শতক) ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হতো। বাঁধ দেওয়ার পর ৬০০ টাকা লাগে। নদী বাঁচাতে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে করা গবেষণায় বোরো ধানের উৎপাদন কমিয়ে আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ফসলে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। এর পরিবর্তে কম পানি প্রয়োজন হয় এমন শাকসবজি আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভুজপুরে ১৩টিসহ ফটিকছড়িতে মোট ১৭টি চা-বাগান রয়েছে। এই বাগানগুলোর পানির মূল উৎস হালদা। কৃষি কর্মকর্তা লিটন দেবনাথ বলেন, চা-বাগানগুলো কোনো না কোনোভাবে হালদা থেকে পানি উত্তোলন করে। গবেষণায় শুকনো মৌসুমে হালদা থেকে চা-বাগানগুলোকে পানি তুলতে বারণ করার সুপারিশ করা হলেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেই।

No comments

Powered by Blogger.