এবার নতুন সংকটে ট্রাম্প

আপিল আদালতে নিজের নির্বাহী নির্দেশের ওপর আরোপিত স্থগিতাদেশ রদ করতে ব্যর্থ হওয়ার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই ত্রিমুখী সংকটে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জানা গেছে, ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিন ওয়াশিংটনে রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে গোপনে কথা বলেছেন, যার বিষয়বস্তু ছিল রাশিয়ার ওপর ওবামা প্রশাসনের আরোপিত বিধিনিষেধ। এই যোগাযোগ জাতীয় স্বার্থবিরোধী—এই যুক্তিতে ফ্লিনের পদত্যাগ দাবি করেছেন বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা। রাশিয়ার হাতে ট্রাম্পের অশালীন ব্যবহারের গোপন তথ্য আছে, এমন কথা কয়েক সপ্তাহ আগে জানা গিয়েছিল। ট্রাম্প এটাকে ‘মিথ্যা কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন জানা যাচ্ছে, মার্কিন গোয়েন্দারা সে তথ্যের অংশবিশেষ সত্য বলে প্রমাণ পেয়েছেন। তবে ট্রাম্পের জন্য আশু চ্যালেঞ্জ মুসলিম নিষিদ্ধাদেশের ব্যাপারে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ। গত শুক্রবার হোয়াইট হাউস থেকে প্রথম জানানো হয়, ট্রাম্প নতুন নির্বাহী আদেশ জারি করবেন।
সে ঘোষণার কিছু পরে জানানো হয়, ট্রাম্প এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবেন। দিনের শেষে আরেক ঘোষণায় জানানো হয়, ট্রাম্প একই সঙ্গে নতুন আদেশ জারি ও সুপ্রিম কোর্টে আপিলের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এর ওপর আরও রয়েছে ট্রাম্পের উপদেষ্টা কেলিঅ্যান কনওয়ের আইনি ঝামেলা। তিন দিন আগে তিনি ফক্স টিভিতে ট্রাম্পের মেয়ে ইভানকা ট্রাম্পের কোম্পানির কাপড়চোপড় কেনার জন্য দেশের নারীদের প্রকাশ্যে উৎসাহ দিয়েছেন। একটি মার্কিন বাণিজ্য সংস্থা ব্যবসা মন্দ বলে ইভানকার প্রতিষ্ঠানের তৈরি পোশাক কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল। হোয়াইট হাউসের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়া সরকারি নৈতিকতাবিষয়ক নীতিমালার লঙ্ঘন, এই অভিযোগে তাঁর ব্যাপারে কংগ্রেসের অধীনে তদন্তের দাবি উঠেছে। হোয়াইট হাউস বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ‘কনওয়েকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে’ বলে জানিয়েছে। বর্ষীয়ান ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান ইলাইজাহ কামিংস কংগ্রেসের নজরদারি ও সংস্কারবিষয়ক কমিটির প্রধান জ্যাসন শাফেৎজকে চিঠি দিয়ে কনওয়ের ব্যবহার ‘সরকারি নিয়মবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন’ উল্লেখ করে দাবি করেছেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। জেনারেল ফ্লিনের তুলনায় কনওয়ের ব্যবহার প্রায় নিরীহ একটি ব্যাপার। মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া সাইবার হামলা করেছে, এই অভিযোগের ভিত্তিতে ওবামা প্রশাসন গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং বেশ কয়েকজন রুশ কূটনীতিককে দেশ থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেয়। জবাবে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন জানান, মস্কো কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেবে না। তিনি উল্টো মস্কোতে অবস্থানরত মার্কিন কূটনীতিক ও তাঁদের ছেলেমেয়েদের ক্রেমলিনে এক ক্রিসমাস পার্টিতে আমন্ত্রণ জানান।
ওবামা প্রশাসন সে সময়েই ইঙ্গিত করেছিল, পুতিনের এই উদারতার পেছনে কোনো গোপন চাল রয়েছে। এখন জানা গেছে, ওবামার নিয়ন্ত্রণাদেশ জারির আগে ও পরে জেনারেল ফ্লিন ওয়াশিংটনে রুশ রাষ্ট্রদূত সের্গেই কিসলিয়াকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং টেক্সট চালাচালি করেছেন। টেলিফোনে যোগাযোগের কথা ফ্লিন নিজেই স্বীকার করেছিলেন, তবে জানিয়েছিলেন তাঁদের আলোচনার বিষয় মার্কিন বিধিনিষেধ আরোপ নিয়ে নয়। তিনি রুশ রাষ্ট্রদূতকে ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মাত্র। পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র শন স্পাইসার জানিয়েছিলেন, ফ্লিন নতুন বিধিনিষেধ নিয়ে কোনো কথা বলেননি, ট্রাম্প ও পুতিনের সম্ভাব্য সাক্ষাৎকারের বিষয়টি তাঁরা আলোচনা করেছেন মাত্র। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, ফ্লিন রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে শুধু ওবামা আরোপিত নতুন নিয়ন্ত্রণ বিধিনিষেধ নিয়েই আলোচনা করেননি, তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন এসব বিধিনিষেধ দ্রুত বাতিল করা হবে। ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস একাধিক উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই কথা নিশ্চিত করেছে যে তাঁদের এই কথাবার্তার রেকর্ডিং মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে আছে। বিদেশি কূটনীতিকদের আলাপচারিতায় আড়ি পাতা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বুধবার ফ্লিন দুবার স্পষ্টভাবে বলেন, তাঁর সঙ্গে রুশ রাষ্ট্রদূতের বিধিনিষেধ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার ফ্লিন তাঁর বক্তব্য পাল্টে বলেন, কী কী বিষয়ে কথা হয়েছে তাঁর সঠিক মনে নেই, তবে নিয়ন্ত্রণাদেশ নিয়ে আলোচনা হলেও হয়ে থাকতে পারে। ফ্লিনের কথা এভাবে পাল্টানোয় ক্ষুব্ধ হয়েছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স। একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, নিয়ন্ত্রণাদেশ নিয়ে রুশ কূটনীতিকের সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি, ফ্লিন নিজেই তাঁকে বলেছিলেন। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে ফ্লিন গুপ্তচরবৃত্তি অথবা দেশদ্রোহের মতো অভিযোগের সম্মুখীন হতে পারেন। জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান উপদেষ্টা। (হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১-এ এই দায়িত্ব পালন করেন।) ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যান এডাম শিফ এই প্রশ্নে উচ্চপর্যায়ের তদন্তের দাবি তুলেছেন। তিনি অবিলম্বে ফ্লিনের পদচ্যুতিরও দাবি করেছেন। দুজন ডেমোক্রেটিক সিনেটর নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিসের কাছে এক চিঠিতে ফ্লিনের নিরাপত্তা ‘ক্লিয়ারেন্স’ নতুন করে পর্যালোচনার দাবি করেছেন। মস্কোর হাতে ট্রাম্পের ব্যাপারে আপত্তিকর তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, এ কথা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই জানা গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই গোপন দলিল ব্যবহার করে মস্কো ট্রাম্পকে ব্ল্যাকমেল করতে পারে। এফবিআই এবং সিআইএ এ ব্যাপারে যৌথভাবে প্রস্তুত ৩৫ পাতার একটি দলিল ওবামা ও ট্রাম্পের হাতে তুলে দিয়েছিল। ২০১১ সালে মস্কো ভ্রমণের সময় ট্রাম্প হোটেলে অবস্থানের সময় একাধিক নারীর অংশগ্রহণে অশালীন ব্যবহারে লিপ্ত হন, সেই দলিলে এমন কথা বলা হয়েছিল। ট্রাম্প চেয়েছিলেন ব্যাপারটা গোপন থাকুক, কিন্তু একটি ওয়েব পত্রিকা পুরো দলিলটি ফাঁস করে দেয়। ট্রাম্প ক্রুদ্ধভাবে এই দলিলের সব তথ্য মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এখন জানা গেছে, গোয়েন্দা বিভাগ ইতিমধ্যে এসব অভিযোগের কোনো কোনো অংশ সত্য বলে জানিয়েছে। হোয়াইট হাউস আবারও যথারীতি এই খবরকে ‘মিথ্যা খবর’ বলে বাতিল করে দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.