বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগই প্রধান কারণ

গত দুই বছরে ঢাকায় অন্তত ১০টি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ এবং অসতর্কতার কারণে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তির বাসিন্দারা উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে আগুন লাগানোর অভিযোগ করছে। গত ১০ দিনে রাজধানীর তিনটি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। তেজগাঁওয়ে রেলওয়ে কলোনি বস্তিতে ১০ ফেব্রুয়ারি আগুন লাগে। মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি বস্তিতে গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে আগুন লেগে শতাধিক ঘর পুড়ে যায়।
সর্বশেষ মিরপুরের বাউনিয়াবাদ বস্তিতে গত শুক্রবার অগ্নিকাণ্ডে ৩০টি বসতঘর পুড়ে গেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগ থাকলেও আদতে সেগুলোর কোনো কার্যক্রম নেই। বস্তিবাসীদের জীবনমান উন্নয়ন, পুনর্বাসনের মতো বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও নেই। দুই সিটির বস্তি উন্নয়ন বিভাগের কার্যক্রম মূলত বিদেশি দাতা সংস্থার প্রকল্পকেন্দ্রিক। ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী সড়কের জাফরাবাদে পুলপাড় এলাকার বটতলা বস্তিতে লাগা আগুনে মারা যায় ফাতেমা নামের তিন বছরের এক শিশু। নিঃস্ব হয় পাঁচ শতাধিক পরিবার। গত বছর মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে তিনবার মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে। গত বছরের ১৫ মার্চ কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে। এরপর ২১ নভেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর দুই দফায় আগুন লাগে কড়াইল বস্তিতে। আগুনে কড়াইল বস্তির হাজারখানেক ঘর পুড়ে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গৃহহীন হয় কয়েক হাজার মানুষ। কল্যাণপুর পোড়া বস্তির একটি অংশে গত বছরের ২২ জানুয়ারি আগুন লাগে। এর আগের দিন আদালতের নিষেধাজ্ঞায় বস্তির উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ হয়। বস্তিবাসীর অভিযোগ, উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আগুন লাগানো হয়। একের পর এক বস্তিতে আগুনের ঘটনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক শাকিল নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, বস্তির আগুনগুলো মূলত অসতর্কতার কারণে ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক সংযোগ ও রান্নাঘরের আগুন থেকে বস্তির আগুনগুলোর সূত্রপাত হয়। কল্যাণপুর, সাততলা, বাগানবাড়ি, বাঁশবাড়ি ও সোবহান রোড বস্তি ঘুরে দেখা যায়, বস্তির ভেতরে এলোমেলোভাবে জড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের তার ঝুলছে। মূল সড়ক থেকে এসব অবৈধ সংযোগ আনা হয়েছে, যার ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। ঝুঁকিপূর্ণ এসব সংযোগের কারণে যেকোনো সময় আগুন লাগতে পারে। বস্তিগুলো খুবই ঘিঞ্জি। ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। এসব বস্তির অন্তত ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু অসাধু কর্মচারী ও বস্তির কয়েকজন বাসিন্দা মিলে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বস্তি এলাকার রাস্তা খুবই সরু হওয়ায় আগুন নেভাতে অনেক সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। আবার বস্তির পানির উৎসও সীমিত। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
নগর বস্তিবাসী উন্নয়ন সংস্থার (এনবাস) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হান্নান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, অপরিকল্পিত ঘিঞ্জি ঘর, সাধারণ তার দিয়ে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ, রান্নার ক্ষেত্রে অসাবধানতার কারণে বস্তিগুলোতে আগুন বেশি লাগছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বস্তি উচ্ছেদ করার জন্যও অগ্নিকাণ্ডের ষড়যন্ত্র হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৪ সালের ‘বস্তিতে শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা’ শীর্ষক প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত ১ হাজার ৬৪৪টি বস্তিতে ১ লাখ ৪২ হাজার পরিবার থাকে। উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বস্তির সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৬টি। এসব বস্তিতে বাস করে ৪১ হাজার ৬১১টি পরিবার। প্রতিটি পরিবার বা খানার গড় সদস্যসংখ্যা ৩ দশমিক ৭৩। সে হিসাবে ঢাকায় বস্তিতে থাকে প্রায় ৬ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ। বস্তিবাসীর পুনর্বাসন ও জীবনমান উন্নয়নে এখন পর্যন্ত দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। এ বিষয়ে ডিএনসিসির বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ভুঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, বস্তিগুলোর বিষয়ে সিটি করপোরেশনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে না। কাজগুলো মূলত বিদেশি দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থার প্রকল্পভিত্তিক। এসব প্রকল্পের অংশ হিসেবে বস্তিতে সচেতনতাবিষয়ক নানান কার্যক্রম চালানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.