শহীদ দিবসকে কালজয়ী করে শহীদ মিনার

২১ ফেব্রুয়ারির শহীদদের রক্তাক্ত স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ক্রুদ্ধ প্রতিবাদী মিছিলে স্লোগান ওঠে, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। কার কণ্ঠে এই স্লোগান উচ্চারিত হয়েছিল, সেটা আজ আর জানা যাবে না। তবে এ কথা সত্য যে সেদিন নুরুল আমিন সরকার সশস্ত্র পুলিশ ও ইপিআর সেনা জওয়ানদের নামিয়ে রাজপথে একের পর এক রক্তের ছাপ এঁকে দিয়েছিল। শহীদ শফিউর-আউয়াল-অহিউল্লাহ-সিরাজুদ্দিন প্রমুখ নাম চেতনায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। দিনভর মিছিলে হাঁটার শেষে পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রের জটলায় আলোচনার বিষয় ছিল পুলিশের গুলি ও পরপর দুই দিন ছাত্র-জনতাকে হত্যা। সম্ভবত পূর্বোক্ত স্লোগানটিই উপস্থিত কারও চিন্তা উসকে দেয়, তাই প্রস্তাব, শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে হবে।
উপস্থিত সবাই এক কথায় রাজি। তবে আজ আর নিশ্চিত বলা যাবে না কে এই প্রস্তাব করেছিলেন। ব্যস, শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি পর্বের কাজ—রাজমিস্ত্রি ও মাল-মসলা জোগাড়। কলেজ প্রাঙ্গণে জমা ছিল বিস্তর ইট-বালু, গুদামে সিমেন্ট। গুদামের চাবিও সহজেই পাওয়া গেল হোসেনি দালান এলাকার বাসিন্দা পিয়ারু সরদারের কাছ থেকে। কাজ শুরু রাত ১০টা থেকে। স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কাজ শেষ হয় খুব ভোরে। প্লাস্টার করা শহীদ মিনারটি ঢেকে দেওয়া হয় শোকের প্রতীক কালো কাপড়ে। চারদিক দিয়ে দড়ির ঘের, দড়িতে টানানো পোস্টার, লাল বর্ণমালার। তাতে লেখা রকমারি স্লোগান। এমন স্লোগানও ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা তহবিলে মুক্ত হস্তে দান করুন’, ‘ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিন’ ইত্যাদি। খবর দ্রুতই পৌঁছে যায় শহরের বিভিন্ন মহল্লায়। তাঁরা ছুটে আসেন শহীদ মিনার দেখতে। এই দেখা তাঁদের সরকারের বিরুদ্ধে আরেক দফা উত্তেজিত করে। সরকারবিরোধী স্লোগানে মিনার এলাকা মুখর হয়ে ওঠে, তবে তা ক্বচিৎ। অধিকাংশ মানুষকে নীরবে প্রার্থনার ভঙ্গিতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
কখনো হাতে ফুল বা অন্তত একগুচ্ছ পাতা। স্মৃতিস্তম্ভটি এভাবে দর্শনার্থীদের কাছে পবিত্র মাজারের মর্যাদা পেয়ে যায়। দেখেশুনে মনে হয়েছে, বাঙালি কি প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও ভক্তিতে মুক্তি খোঁজে? শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির পর প্রথম আলোর সকালটি ছিল রোববার, সরকারি ছুটির দিন। হয়তো তাই দুপুর গড়িয়ে বিকেল থেকে শহীদ মিনার দেখতে মানুষের পর মানুষ, মিনার কখনো নিঃসঙ্গ হয় না। নরনারী, শিশু—নানা বয়সী মানুষের ভিড় সেখানে লেগেই থাকে। মনে হয় গোয়েন্দা বার্তায় শঙ্কিত মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। তাই দ্রুতই সিদ্ধান্ত স্মৃতিস্তম্ভটি ধ্বংস করার। ইতিমধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে দু-একজন মেডিকেল ছাত্রের উদ্যোগে শহীদ সফিউর রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমানকে দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে তড়িঘড়ি শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। পরে অবশ্য হোস্টেলের ছাত্রনেতারা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন আজাদ সম্পাদক সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার। কারণ তিনি পুলিশের গুলি চালনার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দিনটি ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। জমায়েত কম ছিল না। ছাত্রদের পাশে বেশ কিছুসংখ্যক সাধারণ মানুষেরও উপস্থিতি দেখা গেছে। অনুষ্ঠানের ছবি তুলেছিলেন আমার সহপাঠী হুমায়ুন কবির। পরে এ বিষয়ে তাঁর লেখা ছোট একটি নিবন্ধ ইত্তেফাক-এ ছাপা হয়, যাতে ওই ছবি ছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারির পর মাত্র আড়াই দিনের মাথায় ২৬ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিন সরকারের সশস্ত্র পুলিশ শেষ বিকেলে মেডিকেল হোস্টেল ঘেরাও করে শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে।
শেষ ইটের টুকরোটিও তারা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। পেছনে রেখে যায় ডিজেলের পোড়া গন্ধ ও কিছু ধোঁয়া। হোস্টেলে তখন সামান্য কজন ছাত্র। তাঁরা পুলিশের উঁছিয়ে ধরা রাইফেলের মুখে এই করুণ দৃশ্যটি দেখেন। প্রতিবাদের উপায় ছিল না, ছবি তোলারও সুযোগ ছিল না। এভাবে একটি ইতিহাসের মৃত্যু ঘটে। এ সম্পর্কে মাত্র ছোট্ট একটি খবর আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয়, ‘গতকল্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে শহীদানের যে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করা হইয়াছিল, পুলিশ সন্ধ্যায় তাহা ভাঙিয়া ফেলিয়াছে।’ কিন্তু শহীদ মিনার মরেনি। দেশজুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য ছোট-বড় আকারের শহীদ মিনার। পরে সরকার প্রথম শহীদ মিনারের কাছাকাছি স্থানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করে।
আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, কবি ও রবীন্দ্র-গবেষক

No comments

Powered by Blogger.