পশ্চিমবঙ্গে বইমেলা ও ভোট–পার্বণ

বাংলায় কথাটা বেশ প্রচলিত: ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। অর্থাৎ উৎসব লেগেই আছে। বেশ কয়েক বছর হলো পশ্চিমবঙ্গবাসীর ক্যালেন্ডারে নতুন একটা পার্বণ যুক্ত হয়েছে। বইমেলা। কলকাতা বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর রাজ্যের জেলায় জেলায় তো বটেই, বিভিন্ন শহরের নানা জায়গায়ও বইমেলার আয়োজন শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতাসহ জেলা শহরগুলোয় কত বইমেলা যে হয়, গুনে বলতে পারব না। ফি বছর একটা–দুটো করে মেলা বেড়েই চলেছে। আমার কিন্তু বেশ লাগে। বই বিক্রি হোক না-হোক, বইকে ঘিরে মেলা—মানুষের এই যে সমাবেশ, এটাই তো কত সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর। শৈশব-কৈশোরে দেখেছি, পারিবারিক অনুষ্ঠানে বই উপহার দেওয়ার একটা রীতি ছিল। আজ বহু বছর সচরাচর কেউ কাউকে বই উপহার দেয় না।
বই উপহার দেওয়াটা কেমনভাবে যেন ‘ডাউন মার্কেট’ হয়ে গেছে। পৌষ-মাঘ ও ফাল্গুন মাসে যখনই কোনো বইমেলায় ভিড় দেখি, ভাবি, যত মানুষ মেলায় ভিড় জমায়, তারা যদি বছরে অন্তত কোনো একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে কাউকে বই উপহার দেওয়ার শপথ নেয়, তাহলে সমাজ আরও সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। বইমেলার কথাটা ধান ভানতে শিবের গীতের মতো শোনাবে এবার যে কথাটা লিখব সেটা পড়ার পর। বইমেলা যদি বাঙালির চৌদ্দ পার্বণ হয়, ভারতীয়দের পঞ্চদশ পার্বণটা তাহলে অবশ্যই ভোট। ভারতে গণতন্ত্রের প্রসার যত হচ্ছে, ততই বেড়ে চলেছে ভোটের বহর। এতগুলো রাজ্য এ দেশে। এতগুলো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও ভোট হয়েই চলেছে। লোকসভার ভোট, বিধানসভার ভোট, পঞ্চায়েতের ভোট, পুরসভার ভোট—কোনোটারই যেন শেষ নেই। সব জায়গায় মেয়াদ পূর্তির পরই যে ভোট হচ্ছে, তা–ও নয়। অকাল ভোটও আকছার হচ্ছে। ভোট আসা মানে তাই আরও একটা টানটান উৎসবের মেজাজ। কিছুদিনের মোচ্ছব। ভোটের কথাটা মনে এল ভারতে এখন ভোটের উৎসব চলছে বলে। পাঁচ রাজ্যের ভোট হচ্ছে একসঙ্গে। দফায় দফায়। ফল বেরোবে ১১ মার্চ। ভারতে ভোট গণতন্ত্রের প্রসার ও বিকাশের সহায়ক যতটা ততখানিই আবার উন্নয়নের বাধা হিসেবেও গণ্য হতে শুরু করেছে। এবং অনেকটাই টাকার শ্রাদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই বিষয়টা তুলেছেন। তাঁর এবং তাঁরই মতো আরও অনেকেই মনে করেন, ভোটের বাজনা বেজে গেলে উন্নয়ন থমকে যায়। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার দিন থেকে ফল বেরোনো পর্যন্ত কোনো সরকারই কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে না, সেটা ভোটারদের প্রভাবিত করার শামিল হয়ে দাঁড়াবে বলে। কোনো প্রকল্পের ভিত খোঁড়া যায় না, কোনো নতুন প্রকল্প ঘোষণা করা যায় না, নীতিগত কোনো সিদ্ধান্তও সরকার নিতে পারে না। এখন হিসাব করুন, প্রতিবছর কোনো না কোনো ভোটের ছুতোয় দেড়-দুই মাস সরকারের এই ধরনের কাজ বন্ধ থাকলে উন্নয়ন কতটা থমকে যায়। সরকারের খরচও কতটা বেড়ে যায়। এসব ভেবেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর নতুন ভাবনার কথাটা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি চান, সারা দেশে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একই সঙ্গে করা যায় কি না, সেই বিষয়ে দেশজোড়া একটা বিতর্ক শুরু হোক। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে। আদৌ এ নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধবে কি না, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ভাবনাচিন্তার কথা বললেও বিভিন্ন দলের নেতাদের মধ্যে কোথাও তেমন গরজ দেখছি না। তবে অন্যবারের মতো এবারও এই ভোট-পার্বণে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রতিযোগিতায় কোনো বিরাম নেই। বরং বহর যেন বেড়েছে। ভোট-ভিক্ষায় সব দলই দাতা কর্ণের মতো প্রতিশ্রুতি বিলোনোয় উপুড়হস্ত। নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি, প্রতিশ্রুতি ইশতেহারের বাইরেও। কথার মতো প্রতিশ্রুতিতেও কর দিতে হয় না! তাই বিলোতেও বাধা নেই। ভোট চুকে গেলে অর্ধেক মানুষ ওসব প্রতিশ্রুতির কথা ভুলেও যান। সরকারে যাঁরা আসেন, কিছু কিছু চেষ্টা তাঁরা করেন। তারপর সাধ্যে না কুলোলে ভুলে যান। কেউ কেউ ভাবের ঘরে চুরি করতেও ছাড়েন না। ডান হাত দিয়ে দেন, বাঁ হাত দিয়ে কেড়েও নেন। এখন যে পাঁচ রাজ্যের ভোট-পার্বণ চলছে, সেগুলোর মধ্যে তিনটি তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও পাঞ্জাব। বাকি দুই রাজ্য গোয়া ও মণিপুর জাতীয় স্তরে সেই গুরুত্ব কোনো দিনই আদায় করতে পারবে না। গোয়া নিতান্তই ছোট বলে, আর মণিপুর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য বলে। কিন্তু তাই বলে প্রতিশ্রুতির কোনো অন্ত নেই। সেগুলো কী ধরনের, একটু দেখা যাক।
পাঞ্জাবে টানা ১০ বছর রাজত্ব করছে শিরোমণি অকালি দল—বিজেপি জোট। শাসক জোটকে এবার দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি। অকালি দল তো হাতে চাঁদ পাইয়ে দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে! তালিকাটা এই রকম—১. ক্ষমতায় এলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ নানা দেশে এক লাখ একর জমি চাষবাসের জন্য পাঞ্জাবি কৃষকদের দেওয়া হবে! ২. রাজ্যের ৫০ হাজার বেকারকে ট্যাক্সি দেওয়া হবে, যার জন্য কাউকে এক টাকাও ‘ডাউন পেমেন্ট’ করতে হবে না। ৩. ক্লাস টেন পাস করা মেয়েদের বিনা পয়সায় সেলাই মেশিন দেওয়া হবে। ৪. গ্র্যাজুয়েট হওয়া ছেলেমেয়েদের স্কুটার বা মোটরবাইক দেওয়া হবে। ৫. ১০ টাকা কিলোয় চিনি ও ২৫ টাকা কিলোয় ঘি দেওয়া হবে রাজ্যবাসীকে। ৬. প্রান্তিক কৃষকদের বিনা পয়সায় গ্যাস কানেকশন, গ্যাস চুল্লি ও প্রেশার কুকার দেওয়া হবে। অকালি দলের দোসর বিজেপি এর সঙ্গে যোগ করেছে রাখি উৎসবের দিন নারীদের বিনা ভাড়ায় বাসে চাপার সুযোগ এবং দলিত ও গরিব ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেলে তাদের প্রত্যেককে ১৫ লাখ টাকা করে অনুদান। আর কংগ্রেসই বা পিছিয়ে থাকে কী করে? তারা জানিয়েছে, ক্ষমতায় এলে প্রতিদিন তারা গরিবদের পাঁচ টাকায় ভরপেট খেতে দেবে। প্রকল্পটার নাম ‘সস্তি রোটি’। তা ছাড়া বছরে ২০০ জন তফসিল ও অনগ্রসর পরিবারের ছাত্রছাত্রীকে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি দেবে। দিল্লির পর যে দুই রাজ্যকে ডানা মেলার জন্য আম আদমি পার্টি বেছে নিয়েছে,
তা এই পাঞ্জাব ও গোয়া। গরিবদের বিনা পয়সায় ‘বিজলি ও পানি’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা দিল্লি দখল করেছে। পাঞ্জাবেও তারা সেই মডেল কাজে লাগাতে বিনা পয়সায় সেচের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর বলেছে, ক্লাস নাইনে ভর্তি হলেই বিনা পয়সায় ল্যাপটপ। সেই সঙ্গে পাঁচ টাকায় লাঞ্চ ও ডিনার। এবার অনেকেই মনে করছেন, উত্তর প্রদেশ হতে চলেছে নরেন্দ্র মোদির ওয়াটারলু। মনে হওয়াটা সত্যি হবে না মিথ্যে, সে বিতর্কে না গিয়ে প্রতিশ্রুতির বহরে নজর দেওয়া যাক। শাসক দল সমাজবাদী পার্টি গরিব নারীদের বিনা মূল্যে প্রেশার কুকার দেওয়ার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি জানিয়ে দেয়, গরিব মায়েরা কন্যাসন্তান প্রসব করলে তাঁদের পাঁচ হাজার এক টাকা করে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতি বেশ মানানসই। সমাজবাদী পার্টি বলল, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের বিনা মূল্যে সাইকেল দেবে, বিজেপি সঙ্গে সঙ্গে জানাল, ক্ষমতায় এলে ছাত্রছাত্রীরা কলেজে ভর্তি হলেই তাদের ফ্রি ল্যাপটপ দেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি ওয়াইফাইয়ের সঙ্গে মাসে এক জিবি করে ইন্টারনেট ডেটাও ফ্রি। সমাজবাদী পার্টি বলল, পড়াশোনায় ভালো এমন গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের তারা সৌর আলো দেবে, দেবে স্মার্টফোনও।
মেয়েদের দেবে ব্যাটারিচালিত ই-রিকশা। আর জানাল, বিধবা, অনাথ অথবা প্রতিবন্ধী মেয়েকে যে বিয়ে করবে, সরকার তাকে একটা বাড়ি ও দুই লাখ টাকা দেবে! এর মোকাবিলায় বিজেপি জানিয়ে দিল, সরকার গড়তে পারলে তারা বয়স্ক নাগরিকদের ধর্মীয় পর্যটনের খরচ দেবে। এর বাইরে সব দলই যে বিষয়ে একমত ও দরাজহস্ত, তার লক্ষ্য কৃষিজীবী মানুষ। এক লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ মওকুফ, বিনা পয়সায় সেচের জল ও বিদ্যুৎ, কৃষিপণ্যের উপযুক্ত সহায়ক মূল্য এবং কৃষি বিমার বন্দোবস্ত! বইমেলার বিকাশের মতো এ দেশে রাজনীতিকদের দানসত্রও ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছে বহুমুখী ও বহুরূপী। বিস্ময় একটাই, এত কিছু সত্ত্বেও গো-বলয়ের ভোট শেষ বিচারে জাতপাত ও ধর্মের বেড়া টপকাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে! ধর্ম ও জাতপাতই হয়ে দাঁড়াচ্ছে একমাত্র বিচার্য। ভোটের দিন যত এগোয়, সুশাসন ও সার্বিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ততই মরীচিকার মতো দূরে সরে সরে যায়!
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.