বিচারের অপেক্ষায় ১৭ বছর! by সোহরাব হাসান

উদীচী ট্র্যাজেডির শহীদদের স্মরণে যশোরে নির্মিত স্মৃতিসৌ​ধ
গত শনিবার সকালে বাসে যশোরে পৌঁছাতেই হতচকিত হয়ে গেলাম। অধিকাংশ রাস্তা খানাখন্দে ভরা, দুপাশে ময়লা–আবর্জনা। ফুটপাতগুলো বেদখল। একদা পরিচ্ছন্ন শহরটির এই হাল কেন? স্থানীয় এক সাংবাদিক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে জানান, পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপি​র নেতা মারুফুল ইসলাম গত দুই-আড়াই বছর দৌড়ের ওপর ছিলেন। নাশকতা মামলায় তাঁকে কয়েক মাস জেলও খাটতে হয়েছে। এ কারণে পৌরসভার উন্নয়নকাজ তেমন হয়নি। আর মাস খানেক আগে দায়িত্ব নেওয়া নতুন মেয়র এখনো কাজ শুরু করতে পারেননি। যশোরবাসীর প্রধান সমস্যা ভৈরব নদ ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া। ভৈরব সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হলেও কোনো সরকার বা পৌর কর্তৃপক্ষ প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়নি। নদী বাঁচানোর চেয়ে ‘রাজনীতি’ বাঁচানোই তাদের কাছে বেশি জরুরি। উন্নয়ন-অনুন্নয়ন বিতর্কের চেয়েও যশোরবাসীকে বেশি ব্যথিত ও বিচলিত করেছে সেখানে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার না হওয়া। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে এসব হত্যা মামলা ঝুলে আছে। অনেকে বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। যশোরের সবচেয়ে আলোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয় ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ। ওই দিন যশোর টাউন হল মাঠে আয়োজিত উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জন শিল্পীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এটাই ছিল বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রথম প্রকাশ্য সন্ত্রাসী হামলা। এতে আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ, যাদের অনেকে এখনো বোমার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পরিবার ও স্বজনদের কাছে তাঁরা অসহনীয় বোঝা হয়ে আছেন। কিন্তু রাষ্ট্র বা রাজনীতি খুব একটা এগিয়ে আসেনি। যশোরের সংস্কৃতিসেবীরা প্রতিবছর ৬ মার্চ ‘সংস্কৃতি রক্ষা দিবস’ পালন করেন। কিন্তু সেই সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিসেবীদের যারা খুন করেছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। এ ব্যর্থতার জবাব কী?
যশোরবাসীর একটাই প্রশ্ন, যে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যার বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল, যে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সে সময় সরকার, রাজনৈতিক দল ও সংস্কৃতিকর্মী—সবাই এককাট্টা হয়েছিলেন, গত ১৭ বছরেও তার বিচার হলো না কেন? এ ব্যাপারে কথা বলেছি যশোরের রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবীদের সঙ্গে। সবার ধারণা, মামলাটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কারণেই বিচার হয়নি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সাবেক সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেন, পুলিশই মামলাটি গুবলেট করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে তরিকুল ইসলামসহ বিএনপির কয়েকজন নেতাকে আসামি করা হয়। আর বিএনপির আমলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা রিপোর্ট দেন যে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে বিচার কীভাবে এগোবে?
প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধি মনিরুল ইসলামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিম্ন বিচারিক আদালত মামলার আসামিদের খালাসের আদেশ দিলে সরকারপক্ষ রায় বাতিলের দাবিতে ২০১১ সালে উচ্চ আদালতে আপিল করে। আদালত আপিল আবেদনটি গ্রহণ করে আসামিদের নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। মামলার ২৩ আসামির মধ্যে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত ও অন্য একজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। অন্যরা নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। কিন্তু মামলার সব নথি উচ্চ আদালতে থাকায় নিম্ন আদালত এখনো বিচারকাজ শুরু করতে পারছেন না। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্রের কারণে ২০০৬ সালের ৩০ মে আদালত থেকে খালাস পেয়ে যায় মামলার সব আসামি। পরে সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হলেও উচ্চ আদালত থেকে এখনো পর্যন্ত মামলার নথিপত্র নিম্ন আদালতে এসে পৌঁছায়নি। আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত এ হত্যা মামলায় তরিকুলসহ বিএনপির নেতাদের আসামি করা হলেও পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় যে এটি ছিল জঙ্গিদের কাজ। হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ বা হুজিবির প্রধান মুফতি হান্নান অপর একটি মামলার জবানবন্দিতে বলেছেন, উদীচী হত্যাও তাঁরা ঘটিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার মামলায় বিএনপির নেতাদের জড়ালেও তথ্য–প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। ফলে তরিকুল ইসলাম উচ্চ আদালতে রিভিশন পিটিশন করে অব্যাহতি পেয়ে যান।    একই পরিণতি হয়েছে সাংবাদিক শামছুর রহমান ওরফে কেবল ও রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যা মামলারও। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন জনকণ্ঠের সাংবাদিক শামছুর রহমান। ২০০১ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র দাখিল করে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর মামলার বর্ধিত তদন্তে সাংবাদিক ফারাজী আজমল হোসেনকে নতুন করে আসামি করা হয়। এ সময় মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে বাদ দিয়ে আসামিদের ঘনিষ্ঠদের সাক্ষী করা হয়। ২০০৫ সালের জুন মাসে যশোরের বিশেষ জজ আদালতে এই মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। জুলাই মাসে বাদীর মতামত ছাড়াই মামলাটি খুলনার দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়। এতে মামলার বাদী শামছুর রহমানের স্ত্রী সেলিনা আকতার বিচারিক আদালত পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মামলাটি কেন যশোরে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না মর্মে রুল জারি করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে রুলের জবাব না দেওয়ায় মামলাটির বিচারের প্রক্রিয়া থেমে আছে দীর্ঘ ১১ বছর। দৈনিক রানার সম্পাদক আর এম সাইফুল আলম মুকুল নিহত হন ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট চারখাম্বার মোড়ে দুর্বৃত্তদের বোমা হামলায়। পরদিন তাঁর স্ত্রী হাফিজা আক্তার কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। পরের বছরের ২৩ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে আইনি জটিলতার কারণে মামলার কার্যক্রম থমকে যায়। এ কারণে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি হাইকোর্ট থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ থেকে মুকুল হত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে বর্ধিত তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই বছরের ২১ ডিসেম্বর সিআইডির কর্মকর্তা মওলা বক্স নতুন দুজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। পরের বছরের ১৫ জুন যশোরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল (৩) এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২২ জনকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, যাতে তৎকালীন মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম ও রূপম নামের আরেক আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০১০ সালে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে মামলার ২৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলেও মামলাটি আর এগোয়নি। উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ প্রকাশ করা হলো নবম নিবন্ধটি। যশোরের নাগরিক সমাজ ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা জানান, পূর্বাপর সরকার নৃশংস এসব হত্যা মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে গিয়েই বিচারের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করেছে। যেকোনো মামলায় প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে নকল অপরাধী নিয়ে টানাটানি করা হলে যে মামলার অপমৃত্যু ঘটে, যশোরের তিন আলোচিত হত্যা মামলাই তার প্রমাণ। যেখানে জঙ্গিগোষ্ঠী উদীচী হত্যার দায় স্বীকার করেছে, সেখানে বিএনপির নেতাদের সেই মামলায় যুক্ত করার কী কারণ থাকতে পারে? বিএনপির নেতারা যদি সত্যি সত্যি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতেন, তাঁদের বিচার হলে কারও আপত্তি করার কথা নয়। কিন্তু উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কারণে এই মামলাগুলোর অপমৃত্যুর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ১৭ বছরে মামলার অনেক আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক সাক্ষীকে হয়তো খুঁজেও পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হবে। অথচ দ্রুত জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের প্রথম প্রকাশ্য হামলা ও হত্যার বিচার করা গেলে তারা এতটা বেপরোয়া হতে পারত না।  শামছুর রহমান হত্যা মামলার বেলায়ই বা কী ঘটেছে? যশোরের সাংবাদিক মহল মনে করে, একাধিক চোরাচালান চক্র ও চরমপন্থী গ্রুপ তাঁকে হত্যা করেছে। ঘটনার আগে তারা নানাভাবে শামছুর রহমানকে তাদের বিরুদ্ধে খবর না করার জন্য হুঁশিয়ারও করে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি এই অপরাধী চক্রের কাছে নতিস্বীকার করেননি। মামলার অন্যতম আসামি হাসান সিন্ডিকেটের হাসান র‍্যাবের  সঙ্গে ক্রসফায়ারে খুন হয়েছেন। কিন্তু বিএনপি আমলে সম্পূরক তদন্তের নামে সেই মামলায় সাংবাদিক ফরাজি আজমল হোসেনকে আসামি করা হয়। এটিও ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রহস্যজনক কারণে সাইফুল আলম হত্যা মামলাটির কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।  এতে শঙ্কিত হয়েছেন বিচারপ্রার্থী মানুষ। আর লাভবান হয়েছে সেই অপরাধী চক্র, যারা উদীচী সম্মেলনে বোমা মেরে ১০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে; লাভবান হয়েছে সেই অপরাধী চক্র, যারা শামসুর রহমান ও সাইফুল আলমকে হত্যা করেছে।
এখনো যশোরবাসী আলোচিত তিন খুনের মামলার বিচারের অপেক্ষায় আছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.