ইইউ ছাড়া ঠিক হবে না

ডামবিজা ময়ো
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগ করবে কি না এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সে দেশের ভোটাররা আগামী ২৩ জুন যখন ভোটকেন্দ্রে যাবেন, তখন তাঁদের বিবেচনায় নিতে হবে যে তাঁদের সিদ্ধান্ত দেশটির বেকারত্ব, বাণিজ্যপ্রবাহ এবং আর্থিক বাজারের স্থিতিশীলতার ওপর কী প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া অন্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সেগুলোও ভোটারদের বিবেচনায় নিতে হবে। ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে অর্থনৈতিক যেসব বিতর্ক রয়েছে, তা মোটামুটি সবার জানা। অনেকেই বলেছেন, যদি যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে উৎপাদনকারীরা ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ইউরোপীয় বাজারে তাদের অভিগম্যতা নিশ্চিত করবেন। এর ফলে যুক্তরাজ্যের হাজার হাজার মানুষ তাঁদের চাকরি হারাবেন। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে বিশ্ব অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে লন্ডন তার অবস্থান হারাবে। এ ছাড়া ইইউর বিভিন্ন সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যেসব বাণিজ্যিক চুক্তি রয়েছে, সেগুলো আবার নতুন করে করতে হবে। তবে অনেক ভোটারের জন্য বিষয়টা উদ্বেগের। তাঁদের এই উদ্বেগ যুক্তরাজ্যের সার্বভৌমত্ব নিয়ে। এই ভোটাররা বলছেন, যেকোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের তার ভূখণ্ডের ভেতরে কী ঘটবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত। কেননা দেখা গেছে, ইইউর সদস্য হওয়ার কারণে তাদের মাঝে মাঝে ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থাগুলোর কাছে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হয়।
অর্থনীতির ওপর আমার পিএইচডি ডিগ্রি আছে এবং সেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছি, যাদের কর্মীরা যুক্তরাজ্য ইইউর সদস্য হওয়ায় সুবিধা পেয়েছেন। এবং আমি এখনো মনে করি না যে অর্থনৈতিক বিবেচনায় বা সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগের কারণে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাজ্যের অবস্থানের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ৫০ কোটি জনগণের ইউরোপীয় কমিউনিটির সদস্যপদ যুক্তরাজ্যকে ভূরাজনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ দিয়েছে। বিশ্ব যেখানে দিনে
দিনে জটিল হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের প্রভাব বজায় রাখার বিষয়টি নিঃসন্দেহে যুক্তরাজ্যের জন্য ইতিবাচক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার আগে তারা যেটা অর্জন করেছিল, সে অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসির অনুমান, আগামী ৫০ বছরে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার অর্ধেকে নেমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি বলেছেন, বিশ্ব এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ে প্রবেশ করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বের ৯০ শতাংশ জনসংখ্যার আবাসভূমি এবং এসব জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে। নিশ্চল বা সংকুচিত হয়ে পড়া প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটছে এমন দেশগুলোর জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। যুক্তরাজ্যের ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের অনুমান যে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের দরিদ্র ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশ নাজুক রাষ্ট্রগুলোতে বসবাস করবে। বিশ্ব ইতিমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী–সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এত বড় শরণার্থী-সংকট আর দেখা যায়নি। প্রায় ছয় কোটি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে তা যুক্তরাজ্যকে এই অদ্ভুত ও জটিল বিশ্ব অর্থনীতি থেকে রক্ষা করবে না। এটি কেবল বিদ্যমান ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়া থেকে দেশটিকে বঞ্চিত করবে। ইইউর ভেতরে থেকেই যুক্তরাজ্য বিশ্বরাজনীতিতে ভালোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, যতটা না ইইউর বাইরে থেকে করতে পারবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন যে ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলেও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তার ঐতিহাসিক বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। এর মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। চাইলেও যুক্তরাজ্য এ থেকে সরে যেতে পারবে না। ইইউর ভেতর যুক্তরাজ্য হচ্ছে একটি প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্লকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাজ্যের প্রভাব সীমিত হয়ে আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই ব্রিটিশ যেসব ভোটার এ ব্যাপারে ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের এর পরিণামের কথা বিবেচনা করে ভোট দিতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রোকেয়া রহমান
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ডামবিজা ময়ো: ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ও লেখক।

No comments

Powered by Blogger.