নাজিম হত্যাকাণ্ডের তিন দিনেও ক্লু পায়নি পুলিশ

তিন দিনেও কোনো ক্লু মেলেনি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমউদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ডের। কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়েও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। নাজিমউদ্দিনকে হত্যার দায় স্বীকার করে আল কায়েদার কথিত বার্তা ও তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তার ঘনিষ্ঠদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে তদন্তে সহযোগিতা করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পুলিশের। নাজিম বড় হয়েছেন সিলেটে। মাত্র তিন মাস আগে ঢাকায় এসেছেন। তাই সিলেট থেকেই তিনি কারও টার্গেটে পরিণত হয়েছেন বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় মামলার পর থেকে হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্‌ঘাটনের জন্য সিলেটে নাজিমের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন পুলিশ ও ডিবি’র কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে কয়েক বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, গতকাল জুবেল ও গাফ্‌ফার নামে দুই বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীর চন্দ্র সূত্রধর। নাজিমউদ্দিনের স্কুল-কলেজের ওই দুই বন্ধু জানিয়েছেন, নাজিম ঢাকায় যাওয়ার আগ থেকেই তাদের দেখা-সাক্ষাৎ কম হতো। মুক্তমনা হিসেবে লেখালেখি করার পর থেকেই নাজিমের মানসিকতার পরিবর্তন হতে থাকে। সরকারের বিভিন্ন বিষয়ের সমালোচনা করতো। ভালো কাজের প্রশংসা করতো। ধর্ম নিয়েও লেখালেখি ও মন্তব্য করতো। ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ভালো লাগতো না তার বন্ধুদের। বন্ধুরা তাকে বুঝাতেন। এসব নানা কারণেই নাজিমের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। নাজিমই তাদের এড়িয়ে যেতেন বলে জানিয়েছেন তার বন্ধুরা। নাজিমের বন্ধুরা জানিয়েছেন, তাকে কেউ হুমকি দিয়েছে এমনটি তাদের জানা নেই। তাকে কারা হত্যা করতে পারে এই বিষয়েও ধারণা নেই তাদের। নাজিমের আরও কয়েক বন্ধুকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বন্ধুরা তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও নাজিমের পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করছেন না বলে জানিয়েছে পুলিশ। শুরু থেকেই ভিন্ন রকম আচরণ করছেন তারা। এ ঘটনায় পরিবারের সদস্যরা মামলা করতে চাননি। হত্যাকাণ্ডের পর নাজিমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে সূত্রাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীর চন্দ্র সূত্রধর বলেন, নাজিমউদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। তবু পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করছে। নাজিমউদ্দিনকে হত্যার দায় স্বীকার করে আল কায়েদার কথিত বার্তা সম্পর্কে তিনি জানান, বার্তাটি আল কায়েদার কি-না এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত না। তবে জঙ্গিরা তাকে হত্যা করেছে কি-না বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। কোনো কিছুই তদন্তের বাইরে না বলে জানান তিনি। নাজিমের লেখালেখি সম্পর্কে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সমীর চন্দ্র সূত্রধর বলেন, নাজিম বিভিন্ন বিষয়ে লিখতেন। ফেসবুক ছাড়া কোথাও লিখতেন বলে জানা নেই পুলিশের। গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের যে মেসে থাকতেন নাজিমউদ্দিন তার হত্যাকাণ্ডের পরদিন ওই মেস থেকে তার একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০০৯ সাল থেকে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে ওই ডায়েরিতে লিখেছেন তিনি। ২০১১ সালের ১৭ই মে ওই ডায়েরিতে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল উল্লেখ করে নাজিম লিখেছেন, ‘ফলাফলে প্রমাণিত হয় যে, এখন মুখস্থ পড়ার দিন শেষ।’ একই লেখায় লিখেছেন, ‘নাহিদ ভাইয়ের কল্যাণে আমরা একটি শিক্ষানীতি পেলাম। শিক্ষার  ক্ষেত্রে জাগরণ শুরু হয়েছে। শিক্ষায়  মেয়েদের অংশগ্রহণ এখন সমানে সমান। কোথাও কোথাও বেশিও বটে। ধন্যবাদ শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ ভাই।’ একইভাবে বিএনপির সরকারের সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ধন্যবাদ এহছানুল হক মিলন, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী। নকল বন্ধে যার অবদান অনস্বীকার্য।’
গত ৬ই এপ্রিল রাতে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের একরামপুরের ঋষিকেশ দাশ রোডে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে নাজিমউদ্দিনকে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। নাজিমউদ্দিন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের টুকাভরাউট গ্রামের মৃত আবদুস সামাদের পুত্র।
নাজিম হত্যায় আল-কায়েদার দায় স্বীকার: সাইট ইন্টেলিজেন্স
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমউদ্দিন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা-আনসার আল ইসলাম। এমন দাবি করেছে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ সংস্থাটির বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের দুইদিন পর শুক্রবার রাতে দায় স্বীকারের বার্তাটি প্রকাশ করা হয়।
খবরে বলা হয়, ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদার (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল-ইসলাম বলেছে, ব্লগার নাজিমউদ্দিন সামাদ ফেসবুকে আল্লাহ, নবী মোহাম্মদ ও ইসলামকে অবমাননা করায় ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে তাদের সদস্যরা এই হামলা চালিয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছাত্র নাজিমউদ্দিনকে বুধবার রাত ৯টার দিকে সূত্রাপুরের একরামপুরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে লেখালেখির কারণে নাজিম হুমকি পেয়েছিলেন বলে তার স্বজনরা জানিয়েছেন। এ কারণে তিনি কিছু দিন ফেসবুক বন্ধ রেখেছিলেন। সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক পাস করা নাজিম ঢাকা এসেছিলেন কয়েক মাস আগে। সিলেটে থাকার সময় তিনি গণজাগরণ মঞ্চের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন বলে তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন।
সামাদ হত্যার নিন্দা বৃটিশ আন্ডার সেক্রেটারির
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি টবিয়াস এলউড। তিনি বলেন, ‘নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যার ঘটনায় আমি স্তম্ভিত ও মর্মাহত। আমি মুক্তচিন্তার ওপর এ হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।’ টবিয়াস এলউড বলেন, ‘সহিংসতা কখনোই উত্তর নয়। বাংলাদেশের সব নাগরিকের জীবনের অধিকার অবশ্যই সমুন্নত রাখতে হবে, একই সঙ্গে রাখতে হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত বিতর্কের অধিকারও।’
বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে নাজিমুদ্দিন সামাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন বৃটিশ আন্ডার সেক্রেটারি। তিনি আশা প্রকাশ করেন দায়ীদের শিগগিরই বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ও যে কোনো ধরনের সহিংস চরমপন্থা ঠেকানোর কাজে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দেয়া অব্যাহত রেখেছে।’

No comments

Powered by Blogger.