এ নজির ছড়িয়ে পড়ুক by ইকতেদার আহমেদ

আমাদের রাষ্ট্রীয় মানক্রমে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান ২নং ক্রমিকে। রাষ্ট্রপতির অবস্থান ১নং ক্রমিকে হলেও আমাদের সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় পদ্ধতির বিধায় রাষ্ট্রপতির কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ে অতীব অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি) হওয়ায় তাদের উভয়ের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক নিরাপত্তা সামরিক বাহিনীর দুটি বিভাগ যথা এসএসএফ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) ও পিজিআরের (প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্ট) ওপর ন্যস্ত। উভয়ের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্যান্য বাহিনীর সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে তা সমন্বয়ের দায়িত্বটি এ দুটি বিভাগ পালন করে থাকে। এ দুটি বিভাগসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর অন্যান্য বিভাগের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের সময় তাদের উপস্থিতি রয়েছে এমনসব স্থান, তাদের কার্যালয়, আবাসস্থল ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিñিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে থাকে। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সমপর্যায়ের বিদেশী কোনো অতিথি বাংলাদেশ সফরে এলে নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্ব এ দুটি বিভাগ পালন করে থাকে। কিছু কিছু ক্ষমতাধর রাষ্ট্র তাদের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের বিদেশ সফরকালীন বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োজিত করলেও তারা এ দুটি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকে। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সফরের দু-একদিন আগেই সফরকারী দেশে গিয়ে উপস্থিত হয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাইরের যে কোনো দেশে সফরে গেলে এ দুটি বাহিনীর সদস্যরা তাদের সফরসঙ্গী হন এবং ক্ষেত্রবিশেষে সফরের দু-একদিন আগে সফরকারী দেশে গিয়ে উপস্থিত হন।
গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ পদ্মা সেতুর নদীশাসন ও সেতুটির মূল পাইলিং কাজ উদ্বোধনের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে হেলিকপ্টারযোগে শরীয়তপুরের জাজিরায় যান এবং সেখানে নদীশাসনের কাজ উদ্বোধনের পর নদীর অপর পাড় মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় এসে সেতুটির মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। ওই দিন তিনি মাওয়ায় এক জনসভায়ও ভাষণ দেন। সফরসূচি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা ফেরার কথা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি সড়কপথে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিক সড়কপথে ঢাকা ফেরার আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেন। ঢাকা ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরকে শীতলক্ষ্যা সেতুর টোল প্লাজা এবং মেয়র হানিফ উড়াল সেতুর টোল প্লাজা অতিক্রম করতে হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তার সামরিক সচিব গাড়িবহরের প্রতিটি গাড়ির টোলের টাকা প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
টোল প্লাজার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিলাম ডাকের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়। অতীতে দেখা গেছে, আমাদের দেশে অতীব অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি) এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (ভিআইপি) অনেকে এ ধরনের টোল প্লাজায় কোনো ধরনের টোল প্রদান না করেই টোল সেতু বা টোল উড়াল সেতু অতিক্রম করতেন। এতে নিলামে ডাকার মাধ্যমে টোল আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক ক্ষতি হলেও রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের পদস্থদের কাছ থেকে টোল নেয়া না হলে তা তাদের নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সহায়ক হবে এ বিবেচনায় অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক টোল আদায়ে অনীহ ছিলেন। আবার পদস্থ অনেকের ক্ষেত্রে এমনও শোনা গেছে, এরূপ টোল দেয়া তাদের নিজেদের ও পদের জন্য মর্যাদাহানিকর বিবেচনায় তারা টোল দেয়া হতে বিরত থাকতেন।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে টোল সেতু, টোল উড়াল সেতু ও টোল এক্সপ্রেসওয়ে রয়েছে। এসব সেতু, উড়াল সেতু অথবা এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় পদ্ধতি কম্পিউটারাইজড হওয়ায় একজন ব্যক্তি নিজ দেশের বিবেচনায় যতই পদস্থ হন না কেন, টোল প্রদান ছাড়া তার গাড়ি সেতু, উড়াল সেতু বা এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রমের কোনো সুযোগ নেই। আবার অনেক দেশে শহরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ব্যস্ত সময়ে অতিক্রম করতে হলে টোল প্রদান করতে হয়। এসব পথে চলাচলকারীরা ইলেকট্রনিক টোলকার্ড কিনে তা গাড়ির নির্ধারিত স্থানে ইলেকট্রনিক কার্ড হোল্ডারের মধ্যে রেখে থাকেন এবং গাড়িটি ব্যস্ত সময় সড়ক অতিক্রমকালীন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে টোলের টাকা ইলেক্ট্রনিক কার্ড থেকে পরিশোধ হয়। এ ক্ষেত্রেও পদমর্যাদা যাই হোক না কেন, ইলেক্ট্রনিক কার্ডের মাধ্যমে নির্ধারিত অংকের টাকা পরিশোধ ছাড়া পথ ব্যবহারের সুযোগ নেই।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সড়কপথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সময় তাদের চলাচলকে দ্রুত ও নির্বিঘ্ন করার জন্য সড়কটি যানবাহনশূন্য করা হয়। এভাবে দেখা যায় সড়কটি ১৫-৩০ মিনিট যানবাহনশূন্য থাকে। এ সময়ের মধ্যে সড়কটির সঙ্গে যেসব সড়কের সংযোগ রয়েছে, প্রতিটির মুখে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এ যানজটের রেশ সমগ্র শহরের যানবাহনের ওপর পড়ে এবং তা দীর্ঘসময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
কোনো উন্নত দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের চলার সময় সাধারণ মানুষের চলার পথ বিঘ্নিত করা হয় না। এমনও দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে যাওয়ার পথে যানজটে পড়লে তিনি দ্রুত কার্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য তার গাড়ি ত্যাগ করে ট্রেনে আরোহণ করেছেন এবং ট্রেনে বসার সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। যানজটে পড়ে একজন প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি ত্যাগ এবং ট্রেনে দাঁড়িয়ে থেকে গন্তব্যে পৌঁছানো যুক্তরাজ্যের মানুষের কাছে কোনো ব্যতিক্রম হিসেবে পরিলক্ষিত হয়নি। কারণ তারা মনে করে আইন সবার জন্য সমান। তাই যানজট যত তীব্রই হোক না কেন, অপরের চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের পথ সুগম করার কোনো সুযোগ নেই। একজন প্রধানমন্ত্রী তার যাত্রাকালীন ট্রেনে বসার জায়গা পেল কী পেল না এটি সে দেশের মানুষের কোনো ভাবার বিষয় নয়। তারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী একজন সবল ও সুস্থ ব্যক্তি এবং স্বল্প যাত্রাপথে তিনি ট্রেনের আসনে বসার জায়গা না পেলেও তা তার শরীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেও মনে করেন না তিনি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় তার কোনোরূপ মর্যাদাহানি ঘটেছে। বরং সেদেশের জনগণ মনে করে, এতে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদাই বৃদ্ধি পেয়েছে।
যানজট আমাদের ঢাকা শহরের নিত্যদিনের সমস্যা। যানজটের জন্য অনেকাংশে যে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা দায়ী এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে যানজট নিরসনের চেয়ে ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্ট যে ট্রাক, বাস, অটোরিকশা ইত্যাদিতে চাঁদা আদায়ে অধিক ব্যস্ত থাকেন, তা যে কোনো রাস্তার মোড়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই দেখা যায়। ঢাকা নগরীর যানজটের কারণে আমাদের অর্থনীতির অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের জন্য বিকল্প পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে এবং ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্টদের চাঁদা আদায়ের পরিবর্তে নিজ দায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জনগণের সেবক। একসময় এ দুই শীর্ষ পদে বহাল ছিলেন এমন অনেক ব্যক্তি সাধারণ মানুষের মতো প্রতিদিন ঢাকা নগরীতে কোনোরূপ নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই চলাচল করছেন। এরূপ চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের কারও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এমনটি শোনা যায়নি। সুতরাং পদে বহাল থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সড়কপথে চলাচল কীভাবে করলে অপরের চলাচল বিঘ্নিত হবে না, এটি তাদের নিজেদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের দেশে এ দুটি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা চাটুকার দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচল নির্বিঘ্ন করার কারণে সাধারণ মানুষকে যে ভোগান্তি ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, এ কথাটি চাটুকাররা তাদের বলেন না।

আমাদের দেশে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনেকে যানজটে পড়লে অথবা যানজটে না পড়লেও দ্রুত পথ অতিক্রম করার জন্য উল্টো পথ ব্যবহার করে থাকেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মুমূর্ষু রোগীবাহিত অ্যাম্বুলেন্স এবং অগ্নিনির্বাপণ কাজে নিয়োজিত ফায়ার ব্রিগেড ছাড়া অপর কেউ যতই পদস্থ হোন না কেন, উল্টো পথ ধরে যেতে পারেন না। দুঃখ হয় যখন দেখা যায়, অনেকেই গাড়িতে পুলিশের ইউনিফর্মধারী নিরাপত্তা রক্ষী উপবিষ্ট থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উল্টো পথে সগর্বে যাতায়াত করেন।
আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর সব উন্নত দেশের বিমানবন্দরে ভিভিআইপি ও ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় এসব লাউঞ্জের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার ওপর ন্যস্ত। সাধারণত নিলামে সর্বোচ্চ ডাকধারী প্রতিষ্ঠান এ দায়িত্বটি পেয়ে থাকে। সেসব দেশের পদধারীরা যত উচ্চ মর্যাদাবিশিষ্ট হোন না কেন, নির্ধারিত অংকের অর্থ প্রদান ছাড়া লাউঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন না। রাষ্ট্রের পদস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লাউঞ্জ ব্যবহার বাবদ প্রদত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের হিসাব থেকেই যায়। আমাদের দেশে কোনোরূপ অর্থ প্রদান ছাড়াই এগুলো ব্যবহারের প্রাধিকারপ্রাপ্তদের তালিকাটি বেশ বড় হওয়ায় হরহামেশাই এগুলোর অপব্যবহার হচ্ছে। এ ধরনের লাউঞ্জগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিলামে ডাকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ডাকধারী বেরসকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করা হলে এ খাত থেকে রাষ্ট্রের বিপুল অংকের রাজস্ব আয়ের পথ উন্মোচিত হবে। বিদেশে নির্ধারিত অংকের অর্থ প্রদানের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি এসব লাউঞ্জ ব্যবহার করতে পারে।
আমাদের দেশে পদস্থ অনেকের কাছে অনিয়মই নিয়ম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেকের ক্ষেত্রে যেটি অনিয়ম সে অনিয়মটিকে নিয়মের মধ্যে এনে তার গাড়িবহরের প্রতিটি গাড়ির জন্য টোল দিয়ে যে নজির স্থাপন করেছেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর বিস্তৃতি ঘটুক।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.