হ্যাপি নষ্টামি

বছরশেষের সপ্তাহ শুধু আনন্দের নয়, পুলিশের কাছে খুব দুশ্চিন্তার। কারণ এই সময় সব রকমের নষ্টামিই খুব বেড়ে যায়। তারই কিছু কাহিনি।
এমন সুন্দর চোখ আমি কখনও দেখিনি। পাতায় যেন কালো ঝালর। টানা টানা চোখ। তাতে কৃতজ্ঞতা ভরা... বছর সাতাশ-আটাশ বয়স হবে মেয়েটির।’
আমি একটু অবাক চোখে সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাই। তিনি একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, ‘আর বর্ণনা করতে পারব না, ঘটনায় আসি। ক’বছর আগেই ২৪ ডিসেম্বরের রাতে পার্ক স্ট্রিটে ঘটেছিল। সিভিল ড্রেসে জনতার মধ্যে আছি। মেয়েদের দিকে নানা রকম টুকরোটাকরা মন্তব্য ছুড়তে ছুড়তে অনেকে এগোচ্ছে। কিছু কথা তো কান জ্বালা করা। হঠাৎই একটি মেয়ে ‘সমীর, সমীর’ বলে চিৎকার করে উঠল। পাশে এক জন কেউ বলল, ‘এ বাবা! ব্লেড মেরে দিয়েছে!’ তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দেখি, মেয়েটির কনুই থেকে পাঞ্জার কাছ অবধি লম্বা সরু দাগ। তাতে চিড়চিড়ে রক্ত। ভিড় থেকে তাকে বার করে নিয়ে, পকেটে থাকা অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমের টিউব থেকে ক্রিম বার করে, তার হাতে লাগিয়ে দিলাম। এ দিকে সমীর তো ধাঁ। মেয়েটি বলল, বাড়ি যাব। আমি বললাম, ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। দিলাম। গাড়িতে ওঠার সময় সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। ঝালর লাগানো চোখ— যে কথা আগে বলছিলাম।’
পুলিশের ভাগ্যে ওই সময়টায় অবশ্য এমন এমন রোম্যান্টিক মুহূর্ত বিশেষ জোটে না। পার্ক স্ট্রিট ও তার আশেপাশে, রাত হতে না হতে গাদা গাদা লোক আর হইচই, তার মধ্যেই প্রচুর খুচরো ক্রাইম। কিছু আবার তেমন খুচরোও নয়। বাপি সেন-এর ঘটনা সকলের মনে আছে নিশ্চয়ই। তবে পুলিশের অনেকেই বললেন, বেশির ভাগ গন্ডগোলই হয় ২৪ ডিসেম্বর রাতে, ক্রিসমাস ইভ-এ।
‘আমাদের কাজ হচ্ছে, একটু হইচই আর ছোটখাটো হুজ্জোতি করে, লোকেরা মদ-খাবার পেট পুরে খেয়ে সঙ্গিনীকে বগলদাবা করে যাতে ঠিক ঠিক বাড়ি ফিরে যেতে পারে, সেটা দেখা।’ হাসতে হাসতে বললেন প্রাক্তন এক অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার। তার পর বললেন একটি ২৪ ডিসেম্বর রাতেরই কথা।
থানা দুজনকে পার্ক হোটেল থেকে ধরে নিয়ে এসেছিল। কিছু ক্ষণ পরেই ধুন্ধুমার কাণ্ড। আসলে যাদের ধরেছিল, তারা ছিল সাধারণ পোশাকে বিএসএফ-এর জওয়ান। জাগুলিয়ার দিকের কোনও এক ব্যাটেলিয়ন থেকে আসা জনা পাঁচ-ছয় জওয়ান হোটেলে ঢুকে আকণ্ঠ মদ্যপানের পর একটু বেশি ‘হাই’ হলে, তাদের সঙ্গে বাউন্সারদের গোলমাল লাগে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে দুজনকে অ্যারেস্ট করে। জনা চারেক পালিয়ে যায়। যাদের ধরা হয়েছিল, তারা বলে, আমরা জওয়ান। পুলিশ তবু তাদের থানায় নিয়ে যায়। যারা পালিয়েছিল, তারা এলাকায় গিয়ে খবর দেয়। ব্যস, তাদের সঙ্গে শুধু জওয়ান নয়, কয়েক জন কমান্ডার এসে পার্ক স্ট্রিট থানার চেয়ার-টেবিল উলটে ভেঙে, পুলিশের কয়েক জনকে ব্যাপক মারধর করে, নিজেদের লোকদের ছাড়িয়ে নেয়।
তবে, রাস্তার ওপর নিষ্পাপ মজাও আছে। যেমন সান্তা ক্লজের টুপি পরিয়ে দিয়ে কিছু আদায় করা। এমন মজা দেখতে গিয়েই প্যান্টের পাশ-পকেট থেকে হাজার তিনেক টাকা হারিয়েছিলেন আমার পরিচিত জন। হঠাৎই খেয়াল করেন, কেউ তাঁর পকেট হালকা করে দিচ্ছে। এক জনকে জাপটে ধরে ‘পকেটমার! পকেটমার!’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। যাকে ধরেছিলেন, সে ‘আমি!’ বলে তার ডান হাতটি চাদরের থেকে বার করে দেয়। হাতটি কনুই থেকে নেই। হতভম্ব হয়ে ছেড়ে দিতেই, সে মুহূর্তে অদৃশ্য! কাছের পুলিশকে অভিযোগ করতে, তিনি বলে ওঠেন, ‘এই রে! এ ব্যাটা এখানেও এসেছে! আরে মশাই, লোকটার ডান হাত নেই, বাঁ হাতে পকেট মারে। সঙ্গে এক মহিলা থাকে, তার ব্লাউজের মধ্যে টাকা চালান হয়।’
এসপ্ল্যানেড এলাকার এক হোটেলে, এক জন বার ড্যান্সার তার পোশাকগুলো নাচের তালে তালে খুলছিল। ওপরের অংশের শেষ ফালিটা সরানোর আগেই দুজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হোটেলের বাউন্সার ছিল, তারা আটকে দু-এক ঘা দিতেই অন্য দর্শকরা খেপে উঠল। পুলিশ এসে কিন্তু লোক দুটোর বদলে ম্যানেজারকে অ্যারেস্ট করল। কারণ এমন অনুষ্ঠানের অনুমতি ছিল না। পুলিশ অনির্দিষ্ট কালের জন্য হোটেল বন্ধ করে দিল।
এই ন’দিনের দামাল রাতে আর এক উৎপাত হল: বাইক-বাহিনীর উল্লাস-সফর। বছর কয়েক আগে মৌলালির চার্চের কাছ থেকে পার্ক স্ট্রিটের দিকে রওনা হয় অন্তত পঞ্চাশটি মোটর সাইকেল, যার সওয়ারি কয়েক জন মহিলাও। পুলিশ বিশাল ফোর্স নিয়ে এসে, সকলকে লকআপে ভরে। পরের দিন সকালে, আজব ব্যাপার। থানায় হাজির প্রচুর গণ্যমান্য লোক। তাঁদেরই বাড়ির ছেলেমেয়ে মাঝরাতে শহর দখল করতে বেরিয়ে পড়েছে, তাঁরা জানতেন না। পুলিশ ‘পেটি কেস’ দিয়ে সকলকে ছেড়ে দেয়।
এক বার, এই উৎসব সিজনেই, পার্ক স্ট্রিট সংলগ্ন এলাকায় টহলদারি করতে করতে এক কনস্টেবলের চোখে পড়ল, এক মধ্যবয়স্ক লোক, ধুতির ওপর শার্ট, তার ওপরে পুলওভার পরা, ফালুক-ফুলুক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। তার ভুঁড়িটা এমন বিদঘুটে, মানুষের ভুঁড়ি এ-রকম হতেই পারে না। থানায় এনে তল্লাশি করতেই, ‘পেট’ থেকে একশো টাকা থেকে দশ টাকার বান্ডিলে, নব্বই হাজার টাকা বেরল। লোকটা বলল, সে হরিয়ানা থেকে এসেছে, সুতোর ব্যবসা করে। এটা তার পাওনা টাকা। হোটেলে না রেখে, চুরি যাওয়ার ভয়ে সঙ্গে রেখেছে। এখানে উৎসবের রাতে মেয়ে খুঁজতে এসেছে। পুলিশ এই উদ্ভট গল্পটায় বিশ্বাসই করল না, টাকা ‘সিজ’ করল, আর পরের দিন লোকটাকে কোর্টে চালান করল। পরে প্রমাণ হল, লোকটির সব কথা সত্যি!
পাশের রাজ্য থেকে আসা একটি ছেলে, মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের এক বারবনিতাকে নিয়ে, এক ২৬ ডিসেম্বর রাতে এসপ্ল্যানেড পেরিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ গোটা চারেক ছেলে এসে তাকে মারধর করে, মেয়েটাকে টেনে নিয়ে চলে যায়। ছেলেটি কাছের থানায় যায়। পুলিশ তার কথায় ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এক জায়গায় এসে দেখে, একটা ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা, পাশে মেয়েটির এক পাটি জুতো। পুলিশ ভাবল নিশ্চয়ই মেয়েটাকে ম্যানহোলে ফেলা হয়েছে। পরে অবশ্য খোঁজ করতে মেয়েটির বাড়িতে, মানে তার নির্দিষ্ট ঘরে, যাওয়া হল। দেখা গেল, মেয়েটি সেখানেই অাছে। জেরা করতে, সে দুটো ছেলের নাম বলল। তাদের ধরার পর, বাকি দুজনও ধরা পড়ল। পর দিন সকালেই থানায় বিভিন্ন দলের নেতা হাজির! গুণধরেরা তাদেরই পুত্র। মেয়েটি ও তার বাড়িওয়ালির সঙ্গে তাদের কী সব ফিসফিস কথা হল, মেয়েটি অক্লেশে জানাল, ছেলেগুলো তার ওপর কোনও অত্যাচার করেনি, বরং যত্ন করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। ভিনরাজ্যের ছেলেটি হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। কী হবে তাতে, কেস ডিসমিস।
খিদিরপুর রোড দিয়ে জিপ নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের দিকে রাউন্ডে আসছিলেন সঙ্গী সহ এক অফিসার। হঠাৎ দেখেন, দাঁড়িয়ে থাকা মারুতি ৮০০ থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসা এক ভদ্রমহিলা ‘হেল্প! হেল্প!’ চিৎকার করছেন। জানা গেল, ইনি এক জন আর্মি অফিসারের স্ত্রী। স্বামী সহ তাঁদের ক্লাবে গিয়েছিলেন। স্বামী বেহেড হয়ে গেলে আর এক অফিসার এসে তাঁকে প্রস্তাব দেয়, ‘চলুন এক বার গঙ্গার ধার থেকে হাওয়া খেয়ে আসি, তত ক্ষণে ইনি ঠিক হয়ে যাবেন।’ কিন্তু বেরনোর পর থেকেই অফিসার অন্য রকম সুযোগ চায়। পুলিশ ভদ্রমহিলাকে বলে, এখন কী করবেন? ক্লাবে স্বামীর কাছে পৌঁছে দেব? তিনি বলেন, না, বাড়ি পৌঁছে দিন। ওই অফিসারের নামে কমপ্লেন করবেন করবেন তো? ভদ্রমহিলা ডুকরে ওঠেন, ‘কী যে বলেন! স্বামীর বন্ধু যে!’
অবশ্য, কিছু পুলিশও এই ফুর্তিতে শামিল হয়ে পড়েন কখনও-সখনও। এক ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের রাতে কলকাতা দক্ষিণের এক থানার ওসি, সঙ্গিনী সহ এক নামী হোটেলে ঢুকেছেন। সঙ্গিনী, বলাই বাহুল্য, ওঁর স্ত্রী নন। একটু বেশি পানাহারের পর অফিসারের প্রেম চাগিয়ে উঠল। তিনি সর্বসমক্ষেই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে এমন কাণ্ড করতে লাগলেন, বাউন্সাররা এসে বাধা দিল। অফিসার স্বমূর্তি ধরলেন, ‘জানিস, আমি কে?’ বাউন্সাররা জানতে চাইল না। তাঁকে পার্ক স্ট্রিট থানায় নিয়ে গেল। অনেক কিছু হতে পারত, কিন্তু ওসি-র সহকর্মীরা তাঁকে বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু কী করে যেন, ওপরমহলে খবর গেল। রাতারাতি তাঁকে বদলি করা হল। তার পর থেকে তিনি কোনও থানার দায়িত্ব পাননি।
এ সব ঘটনার চেয়েও বড় কিছু কখনও কখনও নিশ্চয়ই ঘটে। যেমন সোনাগাছি থেকে একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দুটি ছেলে ডায়মন্ড হারবার গিয়েছিল। সেখানেই সন্ধেরাতে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা শখে তারা পার্ক স্ট্রিট আসছিল, রাস্তায় দুর্ঘটনায় মেয়েটি মারা যায়। তাকে সেখানে ফেলে ছেলে দুটো পালায়। বেশ কিছু দিন পর বাড়িউলি মাসির পুলিশে ডায়েরির কারণে কাঁটাপুকুর মর্গে থাকা মেয়েটি শনাক্ত হয়। ছেলে দুটির শাস্তি? না, থাক।
আর এক বার তিনটি ছেলে আর দুটি মেয়ে পার্ক স্ট্রিট এলাকায় নাচগান শুনতে আসে। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল এদেরই এক জনের প্রেমিকা। খানাপিনা করে বাইরে আসার সময় অন্য একটি ছেলে ওই প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে। প্রেমিক ছেলেটি ওই ছেলেটির বুকে এমন মারে, সে তক্ষুনি মারা যায়। সকলে মিলে ওই রাতে তাকে বাইপাসের ধারে ফেলে দিয়ে আসে। পরে সকলেই ধরা পড়ে। সাজা পায়। যে গাড়িটি চড়ে তারা সে দিন ফুর্তি করতে বেরিয়েছিল, সেটা এখনও তালতলা থানার কাছে পড়ে আছে।
সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা

No comments

Powered by Blogger.