রাজশাহীর তিন পৌরসভায় অস্বাভাবিক ভোট নিয়ে প্রশ্ন by আনু মোস্তফা

সারা দেশে পৌরসভাগুলোতে গড়ে ৭৩ দশমিক ৯২ ভাগ ভোট পড়লেও রাজশাহী বিভাগের তিন পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এত ভোট কিভাবে পড়ল, এ নিয়ে বিএনপির প্রার্থীরাও সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না। ঢালাওভাবে তারা ভোট কারচুপির কথা বলছেন। পৌরসভাগুলো হচ্ছে- রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট, নাটোরের নলডাঙ্গা ও জয়পুরহাট জেলার কালাই। তিনটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া রাজশাহীর কাকনহাট ও ভবানীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও নাটোরের বড়াইগ্রাম পৌরসভায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে।
রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার ৪৯ পৌরসভার ৭৯৪ কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। এর ২৭৯ কেন্দ্রই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আলোচিত তিন পৌরসভার ২৭ কেন্দ্রের মধ্যে ১৪টি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ভোট বেশি পড়লেও এসব কেন্দ্রে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়- এই দাবি প্রশাসনের।
কেশরহাট পৌরসভার ৯ কেন্দ্রের মধ্যে ৫টি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ৯২ দশমিক ০১ ভাগ ভোট পড়েছে। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শহীদুজ্জামান শহীদ নৌকা প্রতীকে ৭ হাজার ৩৪৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র আলাউদ্দিন আলো পেয়েছেন মাত্র ১০১ ভোট। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উঠে আসেন জামায়াতের হাফিজুর রহমান আকন্দ। তিনি জগ প্রতীকে পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৯৬ ভোট। জাতীয় পার্টির জয়নাল আবেদিন লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ৫৫ ভোট।
জেলা নির্বাচন অফিসার আমিরুল ইসলাম বলেন, ভোটের হার যাই হোক কেশরহাটের সব কেন্দ্রেই শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। এখানে কোনো প্রার্থীর কোনো অভিযোগও নেই। কী হয়েছিল কেশরহাটে- এ প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে। ভোটের তিন দিন আগে বিএনপির প্রার্থী আলাউদ্দিন আলো দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে প্রচারণা থেকে সরে যান। জামায়াতের প্রার্থী (স্বতন্ত্র) হাফিজুর রহমান আকন্দই হয়ে যান মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। গুঞ্জন রয়েছে আলোর সমর্থকরা শেষের দিকে নৌকা প্রতীকের পক্ষে মাঠে নেমে পড়েন। অন্যদিকে জামায়াতের প্রার্থী স্বল্পসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে মাঠে থাকলেও ভোটের দিন কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি দখলে ছিল আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের। তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছেন কোনো বাধা বা আপত্তি ছাড়াই।
অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বরত নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সাহায্য নিয়েই ঢালাও ভোট দেয়া হয়েছে। এটি বাইরে থেকে বোঝার ব্যাপারও ছিল না। কারণ আপত্তি করার কোনো লোক ছিল না। তবে নির্বাচিত মেয়র শহীদুজ্জামান শহীদ দাবি করেন, পৌরবাসী তাকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছেন। এখানে কোনো কারচুপি হয়নি। নলডাঙ্গা পৌরসভায় ৯০ দশমিক ৭০ ভাগ ভোট পড়েছে। নৌকা প্রতীকে ৩ হাজার ১৫ ভোট পেয়ে মেয়র হয়েছেন শরীফ উদ্দিন মণ্ডল। বিএনপির প্রার্থী আব্বাস আলী নান্নু ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ৬৯৫ ভোট। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নলডাঙ্গা পৌরসভার সোনাপাতিল সরকারি স্কুল কেন্দ্রে শতভাগ ও অন্যদিকে নলডাঙ্গা সরকারি হাইস্কুল কেন্দ্রে ৯৯ দশমিক ৮৮ ভাগ ভোট পড়েছে। নান্নুর অভিযোগ, বেলা ৩টার পর তিন কেন্দ্রে প্রায় ১ হাজার ভোটার ব্যালট পেপার না থাকায় ভোট দিতে গিয়ে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিতরাই ভোট কেটে বাক্স ভর্তি করেছেন। আগে থেকেই আইনশৃংখলা বাহিনীর হয়রানিমূলক তৎপরতায় বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে গিয়ে প্রতিবাদ করবে এমন পরিস্থিতি ছিল না।
কালাইতেও ভোট পড়েছে ৯২ দশমিক ৪২ ভাগের বেশি। ভোটের দিন দুপুরের পরপরই এ পৌরসভার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাজ্জাদুর রহমান সোহেল তালুকদার, বিদ্রোহী প্রার্থী আনিসুর রহমান তালুকদার ও জাতীয় পার্র্টির আনিসুর রহমান ভোট বর্জন করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা কেন্দ্র দখল করে ভোট দিয়েছেন। দখল করা এক কেন্দে ৯৪ দশমিক ৬৮ ভাগ ভোট পড়ে। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের খন্দকার হালিমুল আলম জন ৬ হাজার ৮৪৪ ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। বিএনপির প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ৫০০ ভোট।
অস্বাভাবিক ভোট পড়ার বিষয়ে জেলা রিটার্নিং অফিসার তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। অনিয়মের কোনো অভিযোগ নেই। কালাই পৌরসভার ৫ কেন্দ্র ছিল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলোতে অবশ্য কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি।
রাজশাহী বিভাগের কাকনহাটে ৮৯ দশমিক ৭৭ ভাগ, ভবানীগঞ্জে ৭৭ দশমিক ৫২ ভাগ, বড়াইগ্রামে ৮৮ দশমিক ১৮ ভাগ, রায়গঞ্জে ৮৭ দশমিক ৬০ ভাগ ভোট পড়েছে। এসব পৌরসভার মধ্যে ভবানীগঞ্জে ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়া বাকিগুলোতে ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় প্রশাসনের। এর মধ্যে কাকনহাটে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর সমর্থকরা ভোটের আগের দিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হয়ে কাজ শুরু করায় কয়েকটি কেন্দ্রে একচেটিয়া ভোট হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এখানে বিএনপি প্রার্থী কোনো অভিযোগ করেননি।
রাজশাহী জেলায় ৩৯টি কেন্দ্র অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এসব কেন্দ্রেও ভোটের হার বেশি। এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর অতিরিক্ত ডিআইজি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, আইনশৃংখলার দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা একটি প্রশাসনিক বিষয়। তবে ঘোষণা করা হলেও রাজশাহী বিভাগে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্য ভোট গ্রহণে কাজ করেছে।
পাবনার ১০৭ কেন্দ্রের সবগুলো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু পাবনার কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পাবনা সদর পৌরসভার সবগুলো কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ভোট পড়েছে শতকরা ৬৫ ভাগ। রাজশাহী বিভাগীয় নির্বাচন অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ভোটাররা শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট দিয়েছে। পাবনা জেলার কোথাও কোথাও শতকরা ৭৫ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে। এটাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচনার সুযোগ নেই। রাজশাহীর চারঘাটে ৬ কেন্দ্র ছিল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ভোট শেষে দেখা গেছে এসব কেন্দ্রে ৭৫ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে। তাহেরপুরের সবগুলো কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ভোট পড়েছে ৮২ ভাগের বেশি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৪ পৌরসভার ৮৯ কেন্দ্রের মধ্যে ২৫ কেন্দ্র ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে সর্বাধিক ১৭টি। জেলায় ভোট পড়েছে ৭৩ ভাগ। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে ভোট পড়েছে ৭৯ ভাগ। বিভাগের অন্যান্য পৌরসভায়ও ভোটের হার বেশি তবে দৃশ্যমান কোনো অনিয়মের কথা বলছেন না বিএনপি বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা।

No comments

Powered by Blogger.