ইরাকের অনাথ শিশুরা

তের বছর বয়সী দুনিয়া শুনতে পায় না, বলতেও পারে না। কিন্তু সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে সে বলতে পারে কিভাবে তার বাবাকে হত্যা করেছে আইএস। সে তার পাকস্থলীর দিকে ইঙ্গিত করে, গুলির যাত্রাপথ বোঝাতে ব্যবহার করে তার আঙ্গুল। দ্বিতীয় গুলিটি বিদ্ধ হয় তার বাবার পায়ে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি পড়ে যান মেঝেতে। বাবার চেহারা বুঝাতে দুনিয়া নিজের গালে গোঁফ এঁকে দেখায়। তার মা মুনতাহা আলি মনে করেন, ২০১৪ সালের জুনে মারা গিয়েছে দুনিয়ার বাবা। কারণ, তিনি ছিলেন সংখ্যালঘু শিয়া শাবাক গোষ্ঠীর একজন। তার মৃত্যুর একমাস পরেই নিজ শহর ইরাকের মসুল ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে মুনতাহাকে। তিনি এরপর চলে যান উত্তর ইরাকের কুর্দি অঞ্চলে। মুনতাহা বলেন, আমার ছেলেমেয়েরা ওই হত্যা দেখেছে। তারা চমকে উঠেছিল। মুনতাহার স্বামীর নাম সুলাইমান আব্বাস। মসুলে তিনি ছিলেন ট্যাক্সিচালক। এরবিল বাহারকা শিবিরের ছোট একটি কেবিনে নিজের সন্তানদের নিয়ে থাকেন মুনতাহা। এ শিবিরে প্রায় ৪ হাজার উদ্বাস্তু ইরাকির বসবাস। এদের বেশিরভাগই আইএসের উত্থানের পর মসুল ছেড়ে পালিয়েছেন। দুনিয়া ও তার তিন ভাইবোন এমন হাজারো ইরাকি শিশুর অন্যতম, যারা আইএসের হাতে নিজের পিতা বা পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে অনাথ হয়েছে। যদিও এ ধরনের অনাথ শিশুদের কোন নিশ্চিত পরিসংখ্যান নেই। তবে স্থানীয় এনজিও সিএনএস ফাউন্ডেশন এখন পর্যন্ত এমন ৭১২টি অনাথ শিশুকে চিহ্নিত করেছে। এরা সবাই ২০১৪ সালের জুনের পর আইএসের হাতে নিজের পিতা অথবা পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়েছে। এরা সবাই অনুমোদিত শিবিরের বাইরে বসবাস করে। শিবিরের ভেতর বসবাসরত অনাথ শিশুদের কোন পরিসংখ্যান সিএনএস ফাউন্ডেশন দিতে পারেনি। অপরদিকে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এ বছর ‘সঙ্গীবিহীন’ শিশুদের ৫৮৮টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এদের পিতা অথবা পিতা-মাতা নিহত কিংবা নিখোঁজ। ইরাকে মানবিক সহায়তা খুবই অপ্রতুল। ফলে এ পরিসংখ্যানেও পুরো চিত্র উঠে আসার সম্ভাবনা কম। ইউনিসেফের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ করিম এলকোরানি বলেন, এ শিশুরা বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে। যদি তারা একা থাকে, তবে তাদের বিপদের ঝুঁকি খুব বেশি। বিশেষ করে তাদেরকে সদস্য হিসেবে রিক্রুট করতে পারে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার শঙ্কাও আছে। সে তুলনায় দুনিয়া ও তার ভাইবোনকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। কেননা, তাদের অন্তত প্রাণোচ্ছল মা আছেন। মুনতাহা নিজের সাত বছর বয়সী শিশুসন্তান এইসাকে কোলে নিয়ে বলে যাচ্ছেন, আমি এদেরকে ভালোভাবে বড় করতে কাজ করে যাচ্ছি। তাদেরকে একা বড় করা ছাড়া, আমার আর কোন উপায় নেই। আগে আমার স্বামী ছিলেন। কিন্তু এখন শুধু খোদার সাহায্য চাই আমরা।
বড় বোন দুনিয়ার মতো এইসাও বধির ও মূক হয়ে জন্মেছে। সেও সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। নিজের মৃত পিতার কথা উঠতেই সে হাত দিয়ে গড়ন ইঙ্গিত করে দেখায়। মুনতাহা বলেন, কেউ এইসাকে তার পিতার কথা জিজ্ঞেস করলেই সে কাঁদে। এখনও সরকার থেকে কোন সহায়তা পাননি তিনি। কয়েকদিন আগে কুর্দি আঞ্চলিক সরকার পিতা হারানো পরিবারের জন্য অতিরিক্ত সহায়তার ঘোষণা দেয়। কিন্তু ওই ঘোষণা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। উদ্ধাস্তু পরিবারগুলো এখন ত্রাণসংস্থার সাহায্যের ওপরই নির্ভর করে।
সুলাইমানি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যার অধ্যাপক নাজার আমিন বলেন, ইরাক যুদ্ধের অনাথ শিশুরা বহু মানসিক রোগের শিকার হতে পারে। সাত বছর বয়সী শিশু খালেদের মতো অনেক শিশু আছে, যারা নিজের পিতামাতাকেও স্মরণ করতে পারে না।
মসুলে মূল আবাস ছিল খালেদের। এখন সেও বাস করে বাহারকা শিবিরে। আইএসের পূর্বসূরি আল কায়েদা ইন ইরাক তার পিতা-মাতাকে যখন হত্যা করে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২ বছর। তার পিতা ছিলেন ইরাকি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য। এ কারণেই তাকে ও তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন খালেদের চাচা। খালেদ এখন চাচী নাদা সালেম ও চাচা রাকান সুলফেজের যত্নে বড় হচ্ছে। খালেদ ও তার বড় দুই যমজ ভাইবোন জয়নাব ও হামেদকে দত্তক নিয়েছেন তারা। যেসব শিশুকে কেউ দত্তক নেয় না, তাদের আশ্রয় হয় এতিমখানা বা আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু ইরাকের যে কারও পরিবার এত বড় থাকে যে, কেউ না কেউ দত্তক নিয়ে নেয় শিশুদের। সালেম যেমনটি বলছিলেন, আমাদের সমাজে কাউকে এতিমখানায় পাঠানো ঠিক কাজ নয়। আমাদের সংস্কৃতিতে এটা করা হয় না। আমি তাদের ছেড়ে যেতে পারবো না। আমি তাদের মায়ের মতো।

No comments

Powered by Blogger.