ইয়েমেনে বিমান হামলা: যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব ‘মতভেদ’

ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের চলমান বিমান হামলা নিয়ে ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে বলে মত কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের।
ইয়েমেনে হামলার প্রসঙ্গ নিয়ে সবশেষ কিছু ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষকেরা ওই মত দেন।
ইয়েমেনে হামলার বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি অধিবেশন হয়। অধিবেশনটি যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে আহ্বান করা হয়েছিল। সেখানে সমালোচনার মুখে পড়ে সৌদি আরব।
সপ্তাহকাল আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে সৌদি আরব ৩৪ জাতির সন্ত্রাসবিরোধী জোট গঠনের কথা ঘোষণা করে। সন্ত্রাস দমনে সৌদি আরব যথেষ্ট করছে না—এই সমালোচনার জবাব দিতে তারা এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে অনেকের ধারণা। তবে এবার দেশটি এক ভিন্ন বিষয়ে সমালোচনার মুখে পড়ল।
জাতিসংঘ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগ, চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে ভয়াবহ মানবিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশটিতে সৌদি আরবের যুদ্ধবিমানের বেপরোয়া বোমা বর্ষণের ফলে সেখানে লাখো মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, নথিবদ্ধ করা গেছে—এমন নিহত ইয়েমেনির সংখ্যা দুই হাজার ৭০০ ছাড়িয়েছে। অনেক স্কুল ও হাসপাতাল হয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, নয়তো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
গত মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ইয়েমেনে এই মানবিক বিপর্যয়ের জন্য সরাসরি সৌদি আরবের দিকে আঙুল তোলেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, বেসামরিক নাগরিকের ওপর বিদ্রোহীরাও হামলা চালাচ্ছে। তবে অধিকাংশ হামলার জন্য দায়ী সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট।
একই বৈঠকে জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক দপ্তরের সহকারী প্রধান কিউং-ওয়াকাং জানান, অব্যাহত বিমান হামলার কারণে ইয়েমেনে কমপক্ষে ২০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। সেখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থাও প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
বৈঠক শেষে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য এক যৌথ বিবৃতিতে ইয়েমেনে সংঘর্ষ থামাতে অবিলম্বে শান্তি আলোচনা শুরু করার জন্য সব পক্ষের কাছে আবেদন জানান। কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই আলোচনা শুরুর আবেদন জানিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, শুধু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরব জোটের পরিচালিত বিমান হামলায় যুক্তরাষ্ট্র গোড়া থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। সৌদি আরবের যুদ্ধবিমানগুলোকে জ্বালানি সরবরাহ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে এই অভিযানে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইয়েমেনের যুদ্ধে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচিত হচ্ছে সৌদি আরব। দেশটিতে সৌদি জোটের হামলার পেছনে মার্কিন সমর্থন থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও সমালোচনার তর্জনী তাক করা আছে।
বৈঠকে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ার স্বীকার করেন, সৌদি জোটের বিমান হামলার ফলে বেসামরিক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি করেছে। বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সতর্কতা গ্রহণের জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন রাখেন তিনি।
এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সামান্থা পাওয়ার বলেন, ইয়েমেনে যাতে সব আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলা হয়, রিয়াদের কাছে নানাভাবে সে কথার গুরুত্ব প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণেই নিরাপত্তা পরিষদে বক্তব্য দেন জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার।
কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, ইয়েমেন নিয়ে সবশেষ এই ঘটনাপ্রবাহ থেকে অনুমান হয়, ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যে চলতি আঁতাতে সম্ভবত চিড় ধরেছে।
পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির সমঝোতার ব্যাপারে ওবামা প্রশাসনের আগ্রহ সৌদি আরবের মোটেই মনঃপূত হয়নি। এ ব্যাপারে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে নতুন সৌদি বাদশাহ সালমান চলতি বছরের মে মাসে ক্যাম্প ডেভিডে ওবামার ডাকা আরব দেশগুলোর শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ ফেলো স্টুয়ার্ট প্যাট্রিক নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে মন্তব্য করেছেন, সৌদি আরব ইয়েমেনে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে, তার অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। সেখানে মানবিক পরিস্থিতির অবনমন ঘটলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই বিব্রতকর হবে।
ইয়েমেনে সৌদি বোমা বর্ষণে উদ্বিগ্ন হলেও সে দেশে অবশ্য মার্কিন অস্ত্র বিক্রি বন্ধের কোনো লক্ষণ নেই।
সৌদি বাদশাহকে খুশি করতেই ওয়াশিংটন গত সেপ্টেম্বরে এক বিলিয়ন ডলারের এক নতুন অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তির অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো সর্বাধুনিক মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

No comments

Powered by Blogger.