ব্যবসার জন্য নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দেয়ার এক গোপন কাহিনী by মোহাম্মদ হাসান শরীফ

মুসলিম ব্রাদারহুড কি সন্ত্রাসী সংগঠন? তারা এই দাবিই করেছিল। এই দাবিকে যৌক্তিকতা দিতেই ব্রিটিশ সরকার গঠন করেছিল তদন্ত কমিটি। সৌদি আরবে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার জন জেনকিনসকে করা হয়েছিল এই কমিটির প্রধান। না। তদন্তে ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে তদন্তে উঠে এসেছে এক প্রিন্সের প্রতিশোধ আগুনের ভয়াবহতা আর ব্রিটিশরা যে স্রেফ ব্যবসার জন্য ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারে না, তার বীভৎস চিত্র। ব্যবসা পাওয়ার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সত্যকে বিসর্জন দিয়ে ওই প্রিন্সের একটু সদয় দৃষ্টি পাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন, সেটাও পাওয়া গেছে এই তদন্তে। মজার ব্যাপার হলো, যারা এই তদন্তের ব্যবস্থা করতে ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করেছিল, প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাদের মধ্যেই দেখা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি হতাশা।
এ প্রতিবেদনটি আসলে আরব আমিরাতের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটি এবং পাঁচ বছর ধরে তার রাজনীতি কিভাবে ব্রিটিশ-আমিরাতি সম্পর্কে পরিচালিত করেছে, সে কাহিনীই উঠে এসেছে।
গত নভেম্বরে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ব্রাদারহুডের ওপর দমনপীড়ন চালানোর বিনিময়ে আকর্ষণীয় অস্ত্র ও তেল চুক্তির জন্য ক্যামেরনকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল আমিরাত।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই কার্যক্রমে আমিরাতের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি জড়িত ছিলেন। তবে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান, উপসাগরীয় এলাকায় যিনি ‘এমবিজেড’ নামে পরিচিত।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানকে সাম্প্রতিক সময়ে খুব কম দেখা যায়, বা তার কথা শোনা যায়। গুজব রয়েছে খুবই অসুস্থ। এমন প্রেক্ষাপটে ‘এমবিজেড’ কার্যত দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অনেকে মনে করছে।
ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা
ব্রিটিশ তদন্ত প্রতিবেদনটি বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে ‘এমবিজেড’ এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তার তীব্র বিদ্বেষের বিষয়টি।
অনেকে মনে করে, ২০১২ সালে ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসির মিসরের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ঘটনাটি ছিল মোড় পরিবর্তনকারী। এই ঘটনার রেশ ধরেই ব্রিটিশ সরকার ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল জেনকিন্সকে তদন্ত করার দায়িত্ব দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ঘটনাপরম্পরা এবং উদ্দেশ্যের দিক থেকে এটাকে পুরোপুরি সত্যিই বলা যায়। ‘এমবিজেড’-এর কাছে মুরসির জয়ী হওয়া ছিল পুরো অঞ্চলে ব্রাদারহুডের বন্যায় ভেসে যাওয়া এবং স্বৈরতান্ত্রিক উপসাগরীয় অঞ্চলকে তাদের ইসলামি গণতন্ত্রের পতাকাতলে নিয়ে আসার সম্ভাবনার সূচনা।
ব্রাদারহুডের প্রতি ‘এমবিজেড’র বিদ্বেষ প্রকাশ্যে তেমনভাবে জানা ছিল না। অবশ্য পদস্থ একটি ব্রিটিশ সূত্র মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছে, ‘এমবিজেড’ ব্রাদারহুডের সদস্যও হতে পারতেন, অথচ তিনি হয়েছেন তার ভাষায় তাদের বিরুদ্ধাচরণের ব্যাপারে একাট্টা ব্যক্তি। তিনি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন লোক কিন্তু বিষয়টিকে তিনি বহু দূর নিয়ে গেছেন।
গুজব রয়েছে, আমিরাতি ক্রাউন প্রিন্স ব্রাদারহুড সম্পর্কে বিদ্বেষপরায়ণ হওয়ার কারণ, তিনি মনে করেন, গ্রুপটি তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলের জন্য ধর্মকে সঙ্গী করে নিয়েছে।
‘এমবিজেড’-এর অবস্থান বোঝা যেতে পারে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের প্রিজম দিয়ে। এ ধরনের শাসক মনে করতে পারেন, তার ব্যাপকভাবে রক্ষণশীল ও ধার্মিক প্রজারা ব্রাদারহুডকে আকর্ষণীয় গ্রুপ বিবেচনা করে বসতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের আসন টলে যেতে পারে।
কায়রোতে মুরসির নির্বাচন ‘এমবিজেড’র এই আশঙ্কা জোরদার করেছিল। তবে তিনি আরো আগে থেকেই বেশ দীর্ঘ সময় ধরে অভ্যন্তরীণ ফ্রন্টে ব্রাদারহুডকে মোকাবেলা করে আসছিলেন।
‘এমবিজেড’ ২০০৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্রাদারহুড গ্রুপ আল-ইসলাহকে (তারা দাবি করে, তারা পুরোপুরি স্থানীয় সংগঠন, তাদের নজর কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দিকেই) আন্তর্জাতিক সব সমমনা সংগঠনের সাথে তাদের কার্যক্রম ও সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলেছিলেন।
ইসলাহ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিজস্ব কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছিল, রাজনৈতিক সংস্কারের আহ্বান বাড়াচ্ছিল। পরবর্তী দশকে ইসলাহ ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের মুখে পড়ে, তারা এখন নিষিদ্ধ, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ, এর নেতারা হয় কারারুদ্ধ কিংবা বাধ্যতামূলকভাবে প্রবাসে রয়েছেন।
উইকিলিকসে প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ক্যাবলে দেখা যাচ্ছে, ‘এমবিজেড’ বিশ্বাস করছেন, আমিরাতি সরকারে ইসলাহ অনুপ্রবেশ করেছে। তিনি আমেরিকান কর্মকর্তাদের বলেন, আমিরাতে নির্বাচন হলে ইসলাহ সহজেই জয়ী হবে।
আরব বিশ্বে ২০১১ সালে বিপ্লব প্লাবিত হওয়ার পর এসব অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ আঞ্চলিক বিষয়ে পরিণত হয়। ‘এমবিজেড’ দেখছিলেন, কিভাবে ব্রাদারহুডের সমর্থকেরা গণবিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে আড়াল থেকে বের হয়ে আসছে, লিবিয়া থেকে তিউনিসিয়া এবং মিসর থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত দেশে দেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।
মুরসি যখন ২০১২ সালের ২৪ জুন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষিত হন, তখন ‘এমবিজেড’ আমিরাতে ইসলাহর বিরুদ্ধে অভিযানের তদারকি করছিলেন। ইসলাহর নেতাদের গ্রেফতার, কারারুদ্ধ করা হয়, গ্র“পটির নেতারা ক্ষমতাসীন পরিবারের হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে গোপন ক্যু করার চক্রান্তে লিপ্ত বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়।
ঠিক এই পর্যায়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করতে ব্রিটিশ সরকার উদ্বুদ্ধ হয়।
আমিরাতের মুলা ও লাঠিনীতি
২০১৫ সালের নভেম্বরে গার্ডিয়ানে আবুধাবির গণসংযোগবিষয়ক নাটের গুরু এবং ব্রিটিশ নাগরিক সাইমন পিয়ার্সের একটি লিখিত নোট প্রকাশিত হয়। এতে ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালানোর বিনিময়ে ব্রিটেনকে কয়েক শ’ কোটি পাউন্ডের তেল ও অস্ত্রচুক্তির লোভ দেখানো হয়।
‘এমবিজেড’ যেসব স্থানে ব্রিটিশ সরকারকে শুদ্ধি অভিযান চালাতে বলেছিলেন, তার অন্যতম ছিল বিবিসি। তার মতে এই প্রতিষ্ঠানটিতে ‘ইসলামপন্থী সহানুভূতিশীলদের’ অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতি আমিরাতের মুলা ও লাঠি নীতিটি সূচিত হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে। ওই সময় আবুধাবির জাতীয় তেল কোম্পানির মহাপরিচালক আবদুল্লাহ নাসের আল-সুওয়াইদি স্পষ্টভাবে জানান, ওয়েল জায়ান্ট বিপিকে আমিরাতের নতুন ও আকর্ষণীয় তেলচুক্তির দরপত্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, যদিও দেশটিতে বিপি দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করেছে।
আগস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়, তেল দরপত্র থেকে বিপিকে বাদ (অন্তত আংশিকভাবে হলেও) রাখার কারণ হতে পারে, আরব বসন্তের প্রতি ব্রিটিশ সমর্থনে আমিরাতি ক্রোধ। আরো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ঠিক এই সময়টাতেই বেশ কয়েকজন ইসলাহ নেতা লন্ডনে অবতরণ করে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে।
একই সময়ে মানবাধিকার গ্রুপগুলো এই অভিযোগ প্রকাশ করতে থাকে, আমিরাতি কর্তৃপক্ষ ইসলাহ নেতাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ব্রিটিশ পত্রিকাগুলোতে এসব প্রতিবেদন ফলাও করে প্রচারিত হওয়ায় আবুধাবির মধ্যে এই ধারণা দানা বেঁধে ওঠে, লন্ডন তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকতার এই অনুভূতি সম্ভবত শিকড় গেড়েছিল যখন আবুধাবি দেখছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অত্যন্ত দ্রুতগতিতে তাদের দীর্ঘ দিনের মিত্র হোসনি মোবারকের (২০১১ সালে গণবিক্ষোভের মুখে পদচ্যুত হওয়ার সময়) দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
মুরসির নির্বাচনের পর, রাজনৈতিক জোটের কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় বিপি মিসরের গ্যাস খাতে ১১ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্র“তি দেয়। এই ঘোষণা দেয়ার সংবাদ সম্মেলনে ব্রাদারহুড নেতা ও ওই সময়ের মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক উপস্থিত ছিলেন।
‘এমবিজেড’-এর অসহায় অনুভূতি আরেক দফা বাড়ে ওই মাসেই। বিপির ঘোষণার পরপরই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং ক্যামেরনের সাথে সাক্ষাতের জন্য মুরসিকে আমন্ত্রণ জানান।
পরের মাসে ইসলাহ নেতা সাইয়িদ নাসের আল তেনিজি (তিনি আমিরাতের বাইরে প্রবাস জীবনযাপন করছিলেন) ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে আমিরাতি দমন অভিযান নিয়ে গার্ডিয়ানের মতামত কলামে একটি লেখা প্রকাশ করেন। ইসলাহ নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনার করা জন্য তেনিজিকে বিবিসি আরবি বিভাগে আমন্ত্রণ জানানো হয়। একের পর এক ঘটা এসব ঘটনা যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে আমিরাতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বড় ধরনের প্রচারণায় নামতে উদ্বুদ্ধ করে।
আমিরাত জুড়ে টুইটার হ্যাশট্যাগ #UK_supports_traitors ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের ভাষায় ইসলাহর প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থনের নিন্দা জানানো হয় এতে। ২০১২ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে ইসলাহের বিরুদ্ধে চালিত নির্যাতনের আলোকে ব্রিটিশ-আমিরাত জোটের তীব্র সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লেখা হয়। এতে আবুধাবিতে লন্ডনের প্রতি ক্ষোভ বরং আরেক দফা বাড়ে।
ওই সম্পাদকীয় প্রকাশের এক সপ্তাহ পর ফিন্যান্সিয়াল টাইমস আমিরাতের এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, তেলবাণিজ্য থেকে বিপির বহিষ্কার ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়’। তবে সাথে সাথে এই হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করা হয়, ‘পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে দিলে’ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ‘সরে যাবে’ আমিরাত।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপির বিরুদ্ধে হুমকি সম্ভবত আমিরাতের বিরুদ্ধে মিডিয়াকে সমালোচনা করার সুযোগ দেয়ায় ব্রিটেনের প্রতি ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা যদিও আবুধাবিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তারা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তবুও আমিরাতের ক্রোধ বাড়তেই থাকে।
খবরে প্রকাশ, ২০১২ সালের নভেম্বরেও বিপি আশা করছিল, তাদেরকে আবুধাবির কাছে আবারো উষ্ণভাবে গ্রহণযোগ্য করতে ব্রিটিশ সরকার সহায়তা করতে পারে। তখন, ৫ নভেম্বর, যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ৬০০ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যে ১০০টি সামরিক বিমান কিনতে আবুধাবিকে রাজি করানোর চেষ্টায় ক্যামেরন আমিরাত পৌঁছেন।
মিডিয়ায় এ সফরটিকে উচ্চকিত করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী হতে মাত্র দু’জন সাংবাদিককে অনুমতি দেয়া হয়। লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র হিসেবে আমিরাতের সাথে সম্পর্ক আবার ঝালিয়ে নেয়া।
৬ নভেম্বর ব্রিটিশ ও আমিরাত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিরক্ষা ও শিল্প অংশীদারিত্ব ঘোষণা করে, কয়েক শ’ কোটি পাউন্ডের বিমান কেনার চুক্তিও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা বলা হয়, যদিও এই পর্যায়ে তা নিশ্চিত করা হয়নি। এটা সম্ভবত পিয়ার্সের (যারা তাকে চেনেন, তাদের মতে তিনি রাজনৈতিক খেলাটা বেশ ভালোই বোঝেন) নেতৃত্বাধীন আমিরাতের গণসংযোগ কৌশলবিদদের মুলা ও লাঠি নীতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে করা হয়েছিল।
২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর আবুধাবি ঘোষণা করে, তারা বিপির ১.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ কিনছে। এতে সুস্পষ্টভাবেই মনে হয়, যুক্তরাজ্য ও আমিরাতের মধ্যকার সম্পর্কের জটিলতা দূর হয়েছে। বিপিকে তখনো আমিরাতের তেল খেলায় ফিরতে দেয়া হয়নি, তবে তাদের খুব বেশি দিন দূরেও রাখা হয়নি। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ইতঃপূর্বে যে তেলচুক্তি থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল, সেটাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ব্রিটিশ আপস ও পরিবর্তন
২০১৩ সালের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাজ্যের জটিল ও পরস্পর সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক জোটে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছিল আমিরাতি প্রেসিডেন্ট খলিফা রাষ্ট্রীয় সফরের দিয়ে এবং মিসরের ব্রাদারহুডের নেতাদের সাথে ক্যামেরনের একটি গোপন লাঞ্জ মিটিংয়ের মাধ্যমে।
ওই বছরের জুনে মিসরের সিনিয়র কর্মকর্তারা লন্ডনে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন পরবর্তী মাসে মুরসির পরিকল্পিত সফর নিয়ে। ওই সফরটি আর হতে পারেনি, কারণ ৩ জুলাইয়ের গণসমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি ক্ষমতা দখল করে মুরসিকে কারারুদ্ধ করেন।
মিসরে যেদিন মুরসিকে অপসারণ করার অভ্যুত্থানটি ঘটে, ওই একই দিনে আমিরাত তাদের দেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের বৃহত্তম রাজনৈতিক বিচারের রায় প্রকাশ করে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ইসলাহের ৬৯ নেতাকে সাত থেকে ১৫ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
ব্রিটেনে ব্রাদারহুডের জন্য এটা ছিল সন্ধিক্ষণ। মিসরের ক্ষমতা থেকে অপসৃত হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার গ্রুপটির সাথে সম্পর্ক রাখেনি বললেই চলে।
আবুধাবির সাথে বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টায় আমিরাত-যুক্তরাজ্য-ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক ত্রিভুজে আমূল পরিবর্তন ঘটে। আবুধাবির মুলা আর লাঠিনীতির জের ধরে কয়েক বিলিয়ন পাউন্ডের বিমান চুক্তিটি হওয়ার কথা থাকলেও আর কখনো সেটা আলোর মুখ দেখেনি। চুক্তিটি বাস্তবে রূপ দিতে ক্যামেরনের আরেকবার আমিরাত সফরের জন্য তুলে রাখা হয়।
কিন্তু ক্যামেরনের চেষ্টা বিফল হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঘোষণা করা হয়, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা কোম্পানি বিএই সিস্টেমস আমিরাতি চুক্তি পেতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অন্তত প্রকাশ্যে এ নিয়ে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মতো অবস্থায় যুক্তরাজ্য ছিল না। কারণ চলমান ও আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা দেয়ার সামর্থ্য থাকায় আমিরাত দেশটির গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার বিবেচিত হচ্ছিল।
২০০৯ সালে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের। ২০১৩ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ বিলিয়ন। এই বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছিল যুক্তরাজ্যের পক্ষে।
২০১৪ সালের মার্চে নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত ‘নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি সামিটের’ ফাঁকে ‘এমবিজেড’ ও ক্যামেরন বসে ‘আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অনেক ইস্যু’ নিয়ে আলোচনা করেন। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ১৭ এপ্রিল ক্যামেরন ঘোষণা করেন, ব্রাদারহুডের ব্যাপারে তদন্ত করার কথা ঘোষণা করেন। এর ৯ দিন পর এই তদন্তের অংশ হিসেবে জেনকিনস তার প্রথম আমিরাত সফরে আবু ধাবিতে সিনিয়র কর্মকর্তা খালদুন আল মুবারকের সাথে বৈঠক করেন।
যুক্তরাজ্য মিসরীয় ব্রাদারহুড থেকে দূরে সরে গেলেও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নিশ্চিত করা হয়, বেশ কয়েকজন ইসলাহ নেতাকে লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এই ঘটনা স্পষ্টভাবেই আবুধাবিকে ক্রুদ্ধ করে।
মে মাসে আমিরাত ঘোষণা করে, তারা সামরিক প্রশিক্ষক হিসেবে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের ব্যবহার বন্ধ করে দেবে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে বলা হয়, যুক্তরাজ্য ইসলাহসহ ইসলামপন্থী গ্র“পগুলোর হুমকির বিষয়টি নীরবে মেনে নিয়েছে ধরে আমিরাত ক্রুদ্ধ হয়েছে।
অল্প সময়ের মধ্যে আবু ধাবির হতাশা আরো বেড়ে যায় এই গুজবে যে যুক্তরাজ্য ব্রাদারহুড-বিষয়ক তদন্ত গ্রুপটিকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করতে অস্বীকার করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আবুধাবি ক্ষুব্ধ হতে পারে, এই আশঙ্কায় প্রতিবেদন প্রকাশ বিলম্বিত হতে পারে বলে খবর প্রকাশিত হতে থাকে।
কয়েক মাস পর এমবিজেড লন্ডনে ক্যামেরনের সাথে বৈঠক করেন। এর তিন দিন পর ১৯ অক্টোবর টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযান শুরু হবে।
তবে এর পরপরই মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়, সেটা ছিল টেলিগ্রাফ ভাষ্যের বিপরীত। তাতে নিশ্চিত করা হয়, সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ থেকে ব্রাদারহুডকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে।
তবে ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করা যাচ্ছিল না বলে আমিরাতের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে ব্রিটিশ সরকার হিমশিম খাচ্ছিল। এটাই মিডিয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছিল।
তেল মন্ত্র
জেনকিন্সের প্রতিবেদন প্রকাশের প্রেক্ষাপটে বিপি এখন অপেক্ষা করছে, তারা আবুধাবিতে তেল সুবিধাটি পায় কি না তা দেখার জন্য। আমিরাতি জ্বালানিমন্ত্রী সুহাইল আল মাজরুই টেলিগ্রাফকে বলেছেন, বিপি এখনো প্রতিযোগিতায় আছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আমিরাত এখনো মুলা আর লাঠিনীতির পথটিই আঁকড়ে ধরে আছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিমান চুক্তির মতো বিপিকেও জানানো হয়, আবুধাবির তেলে তাদের সুবিধা দেয়া হবে না। টেলিগ্রাফে খবর প্রকাশিত হয়, আমিরাতকে প্রভাবিত করতে যুক্তরাজ্যের ব্যর্থতার জের ধরে বিপি ৭ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিটি পেতে ব্যর্থ হলো।
২০১৫ সাল জুড়ে জেনকিন্স রিপোর্ট নিয়ে নানা রকম গুজব শোনা যেতে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশ-আমিরাত সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে মনে করে তা প্রকাশ করা হয়নি। একই সময় যুক্তরাজ্য সফরকারী আমিরাতি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, তাদের দেশে ব্যবসা করে যুক্তরাজ্য দ্বিগুণ টাকা বানাতে পারে।
এই রাজনৈতিক খেলার পুরোটাই এমবিজেড এবং ব্রাদারহুডের প্রতি তার ব্যক্তিগত ঘৃণার সাথে সংশ্লিষ্ট। তার দেশের অর্থ এবং যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশে প্রভাব বিস্তারে তার সামর্থ্যই জেনকিন্সের তদন্ত শুরুর কাজ করেছে।
ব্রাদারহুডের ‘চরমপন্থীদের সাথে অত্যন্ত দ্ব্যর্থবোধক সম্পর্ক’ রয়েছে বলে পার্লামেন্টে ক্যামেরনের দেয়া মৃদুভাষার বিবৃতিটি আবু ধাবির ক্রাউন প্রিন্সকে সন্তুষ্ট করতে পারে কি না তা এখন দেখার বিষয়।
(মিডল ইস্ট আই অবলম্বনে)

No comments

Powered by Blogger.