বাংলাদেশে অপরাধ ও শাস্তি

একাত্তরে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত গর্হিত অপরাধে দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে সমাজের দশক পুরনো ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করছে বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধ বিচার। এ বিচার অনেক প্রশংসা পেয়েছে। আবার অনেক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছরেরও বেশি সময় পর অবশেষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হতে দেখা যাচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী জটিল ইতিহাসের কারণে এত বছর এসব অপরাধ অমীমাংসিত ছিল। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ যে অমীমাংসিত তা এখনও দৃশ্যমান। মৌলবাদীরা এমনকি পাকিস্তান সরকারও বিচার ও বিচারপরবর্তী শাস্তির বিরোধিতা করেছে। পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষ সুশীলসমাজ বিচার চালিয়ে নিয়ে যেতে ও যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে সরকারকে চাপ দিয়েছে। রোববার অভিযুক্ত দুই যুদ্ধাপরাধী- জামায়াতের আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির পর আবারও এ মতানৈক্য দৃশ্যমান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে আওয়ামী লীগ সরকার যা কিছু সম্ভব করতে সংকল্পবদ্ধ- এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এটাকে যে বিষয়টা দুর্বল করে তা হলো, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যম হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে বেছে নেয়া। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই ফাঁসি আসলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়। এটা বিচার প্রক্রিয়াকে ন্যায়বিচারের প্রত্যয়ের পরিবর্তে প্রতিহিংসার রংয়ে রঞ্জিত করে। ন্যায়বিচারের প্রত্যয়ই হওয়া উচিত একটি রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার ভিত্তি। পক্ষান্তরে এসব ফাঁসি এমন সময় হলো যখন কিনা বাংলাদেশ ইসলামপন্থি মৌলবাদ সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছে। শেখ হাসিনার সরকার যদি ভেবে থাকেন, এসব ফাঁসি বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতিকে দুর্বল করে তুলবে, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। বিরোধীদের বিরুদ্ধে সরকার যে শক্ত (হার্ডলাইন) অবস্থান নিয়েছে, তা তিক্ত-বিরক্ত বিরোধী সহমর্মীদের মধ্য থেকে অনুসারী রিক্রুট করতে জঙ্গি দলগুলোকে সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেছে এমনটা ইতিমধ্যে হচ্ছে। দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং দলটির নেতাদের ফাঁসি দেয়া সত্ত্বেও দলটি সাংগঠনিকভাবে এখনও শক্তিশালী। আর তারা ‘বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা’ করার মাধ্যমে ‘প্রতিশোধ নেয়ার’ অঙ্গীকার করেছে। এছাড়াও, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি শুরু হওয়ার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষ লেখক ও তাদের প্রকাশকদের ওপর হামলা বাড়ার বিষয়টি কাকতালীয় নাও হতে পারে। অন্য কথায়, সরকারের অবস্থান অতীতের অন্যায় লাঘব করার তুলনায় বর্তমানের মতপার্থক্যকে তীব্র করেছে। ঢাকার সামনে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনাটা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে কট্টরপন্থি শক্তিগুলো যেন ওই বিচার প্রক্রিয়াকে তাদের ফায়দা হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে তা প্রতিহত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে তারা হয়তো মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহের ন্যায় সমাপ্তি টানতে পারতো। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের ওপর নির্ভর করায় এ প্রক্রিয়াকে দুর্বল করেছে। এছাড়া এটা সমাদৃত।
[ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দুতে গতকাল প্রকাশিত ‘ক্রাইম অ্যান্ড পেনাল্টি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয়র অনুবাদ]

No comments

Powered by Blogger.