মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার রয়টার্সের বিশ্লেষণ

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিরোধী দুই নেতার ফাঁসির ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সমালোচকদের ধারণা বিদ্যমান শান্ত পরিস্থিতি খুব বেশি দিন থাকবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আর বিরোধী নেতারা সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে, ফাঁসি একটি বার্তা পাঠিয়েছে। তা হলো- সহিংসতাই একমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার যেটা কার্যকর। ইতিমধ্যে গণগ্রেপ্তারের শিকার হওয়া বিরোধীরা যে অভিঘাত অনুভব করেছেন তার বদলে হতে পারে আরও রক্তপাত। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে গতকাল এসব কথা বলা হয়। ‘বাংলাদেশ লিডার হাসিনা’স গেইনস ফ্রম শক হ্যাঙ্গিংস সিন শর্ট লিভড’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭১ আর স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে রোববার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল নীরব। সোমবার মুজাহিদের দল জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডেকেছিল। কিন্তু হরতালের সমর্থনে ঢাকায় কোন মিছিল হয় নি। আর দিনটি বহুলাংশে ছিল শান্তিপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশে হরতাল কর্মসূচি প্রায়ই সহিংস হয়ে ওঠে। সালাউদ্দিন  কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের একজন সাবেক আইনপ্রণেতা ছিলেন। হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির পক্ষে মানুষের বিপুল সমর্থনের কারণে হাসিনার জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্ত্রাসবাদ বা সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে তা ইসলামপন্থিই হোক বা অন্য কোন ধরনের হোক না কেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক মানবাধিকার গ্রুপের সেক্রেটারি বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দৃশ্যত কোন বিরোধী পক্ষ না থাকায় হাসিনা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণতন্ত্রের অভাব শুধুই জঙ্গিবাদের সুযোগ সৃষ্টি করে।’ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসলামপন্থি সহিংসতা বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছে। দুই বিদেশী ও চারজন ধর্মনিরপেক্ষ লেখক ও প্রকাশক এ বছর হত্যার শিকার হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বিরোধী নেতাদের আপিল প্রত্যাখ্যানের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ইতালিয়ান একজন যাজক এবং স্বাস্থ্যকর্মীকে গুলি করে আহত করা হয়। এটা ছিল বাংলাদেশে বিদেশিদের ওপর সব থেকে সাম্প্রতিক হামলা। বিদেশিদের ওপর হামলাগুলোর দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট। কিন্তু সরকার ক্রমবর্ধমান সহিংসতার দায় চাপিয়েছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর। ঢাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিদেশিরা রাস্তাঘাটে হাঁটাচলা এড়িয়ে চলছেন। এমনকি অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ গুলশানের কূটনৈতিক এলাকাতে তারা চলাফেরা সীমিত রাখছেন। ২৫০০ কোটি ডলার সমমূল্যের গুরুত্বপূর্ণ তৈরী পোশাক খাতে প্রভাব পড়েছে। গত মাসে বিদেশিদের হত্যার পর আন্তর্জাতিক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান, এইচএন্ডএম, ইন্ডিটেক্স ও গ্যাপের নির্বাহীরা তাদের ঢাকা সফর বাতিল করেন। গত মাসে ঢাকায় একটি সাহিত্য উৎসবে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও কিছু লেখক অনুষ্ঠানটি এড়িয়ে যান। অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল। বিদেশি যারা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তারা গাড়িতে করে ভেন্যুতে এসেছেন এবং গাড়িতে করেই ফিরে গেছেন। কিছু বাংলাদেশি মনে করেন, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসি ন্যায়বিচার বোধের অনুভূতি দিয়েছে। কিন্তু তারা বলছেন, এর জবাবে মৌলবাদী দলগুলো কি করতে পারে সে অনিশ্চয়তা ভীতিকর। ঢাকায় সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বৃদ্ধি পাবে।’ ইসলামপন্থিরা এ বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে নিন্দা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, ফাঁসির পর এমন দলগুলোর কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসার সম্ভাবনা আরও বেড়েছে। বিএনপির একজন নেতা মুহাম্মদ ওসমান ফারুক এসব সহিংসতা বৃদ্ধিকে ‘অশুভ’ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে দলীয় ও সাম্প্রদায়িক সকল বিবেচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে জনগণের সকল শ্রেণীর কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করেছে।

No comments

Powered by Blogger.