বাংলাদেশে চলাফেরা সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন বিদেশীরা by অ্যানি গোয়েন

কয়েক সপ্তাহ আগেও অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক অ্যানে মার্টন বাংলাদেশে নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারতেন। কাজের জন্য বেছে নিতেন বাইসাইকেল কিংবা রিকশা। ঢাকার বস্তিগুলোর জন্য একটি চাকরি-সেবা পরিচালনা করেন তিনি। কিন্তু মার্টন ও অন্য অনেকের জন্য, এ বছর বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশের জনাকীর্ণ রাজধানীটিতে বসবাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস কর্তৃক দায় স্বীকার করে নেয়া গোলাগুলির কয়েকটি ঘটনা রয়েছে, যেগুলোতে দুই বিদেশী নিহত ও এক ইতালিয়ান মিশনারি কর্মী গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।
কাজে যাবার ক্ষেত্রে অনেকেই হাঁটা বা বাইসাইকেলে চড়া থামিয়ে দিয়েছেন, বেছে নিচ্ছেন কো¤পানির গাড়ি। একটি আন্তর্জাতিক এইডস বিষয়ক সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে, আরও কয়েকটি অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। এ সপ্তাহান্তের ঢাকা লিট ফেস্টে’র মতো যেসব অনুষ্ঠানগুলো আয়োজিত হয়েছে, সেগুলোতে উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাহায্য সংস্থাগুলো নীরবে নিজ নিজ কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যারা এখনও ঢাকায় রয়ে গেছেন, তারা নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী অনলাইনে কিনছেন। অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরছেন ঘরে। মার্কিন দূতাবাস নিজেদের কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বেশিরভাগ পাবলিক প্লেসে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না। এমনকি সড়কে ও ফুটপাতে হাঁটা, আন্তর্জাতিক হোটেল সহ বড় জনসমাবেশে অংশ নিতেও কড়া বারণ।
৬১ বছর বয়সী মার্টন বলেন, আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে আটকে গেছি। আমি নিরাপদ বোধ করিনি। তিনি বলেন, ঘরের বাইরে একমাত্র যে জায়গাটিতে তিনি বসতে পারেন, সেটি হলো শহরের প্রাইভেট ক্লাবগুলো। সেগুলোর উঁচু দেয়ালের বাইরেই পাহারা দেয় সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী। ওখানেই তিনি অন্য বিদেশীদের সঙ্গে সামাজিকতা রক্ষা করেন। মার্টন ও তার স্বামী বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছেন। তিনি বলেন, এটা আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। পুরো উল্টো করে ফেলেছে, সত্যি। আগে যা ছিল, তাতে আমি আর কখনও ফিরতে পারবো কিনা, আমি জানি না।
ফেব্রুয়ারিতে আটলান্টা-ভিত্তিক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান ব্লগার অভিজিৎ রায় তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার একটি বইমেলা থেকে বের হচ্ছিলেন। তখনই চাপাতি হাতে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশ বলেছে, হত্যাকারীরা ছিল উগ্রপন্থী, যারা ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়ে অভিজিতের ধর্মনিরপেক্ষ লেখালেখির বিরুদ্ধে ছিল। এ ঘটনার পর আরও তিন ব্লগার ও অভিজিতের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দিপনকে হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে - এমন শঙ্কা ক্রমেই বেড়েছে সাম্প্রতিক দিনগুলিতে, যখন তিন বিদেশী নাগরিক, শিয়া ধর্মীয় সমাবেশ ও পুলিশ চেকপয়েন্টে হামলার দায় অনলাইনে স্বীকার করে নিয়েছে আইএস। ২৮ই সেপ্টেম্বর ইতালিয়ান এক সাহায্যকর্মী কূটনৈতিক এলাকায় জগিং করার সময় গুলিবিদ্ধ হন। এরপর একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাপানের এক কৃষিকর্মীও গুরুতরভাবে গুলিবিদ্ধ হন ৩রা অক্টোবর। ১৮ই নভেম্বর উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুরে ইতালিয়ান মিশনারি কর্মী পিয়েরো পারোলারি গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। অন্যান্য পাদ্রিরা মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন, ধর্মীয় একটি ফোরামের এক হিন্দু নেতার ওপর মঙ্গলবার ছুরি হাতে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশে নিজেদের কর্মকান্ডের কথিত সম্প্রসারণ নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেছে আইএস। গত সপ্তাহে প্রকাশিত নিজেদের অনলাইন ম্যাগাজিন দাবিকে ‘দ্য রিভাইভাল অব জিহাদ ইন বেঙ্গল’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে বাংলাদেশকে তারা আখ্যায়িত করেছে বেঙ্গল নামে।
নিবন্ধটিতে বলা হয়, এ ধারাবাহিক হামলাগুলোর ফলে বেঙ্গলে বসবাসরত ক্রুসেডার দেশগুলোর নাগরিক ও তাদের সহযোগিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে তাদের কূটনীতিক, পর্যটক ও অভিবাসীরা নিজেদের চলাচল সীমাবদ্ধ করতে ও নিত্য ভয়াল পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির উপস্থিতি অস্বীকার করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক স¤পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভি বলেন, আমাদের মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশে আইএস শক্তিশালী নয়। আমাদের খুব উদার একটি মুসলিম সমাজ রয়েছে। বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে এ দেশে কোন চরমপন্থী মৌলবাদ নেই। বাংলাদেশে আকস্মিকভাবে আইএস সক্রিয় থাকার যে ধারণা, তা অনেক দূরবর্তী বলেই মনে হয়। তবে তিনি আরও বলেন, আমরা অবশ্যই যেকোন সম্ভাবনার বিষয়েই সজাগ। সন্ত্রাসীদের যেকোন হুমকিই আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিই।
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে আইএস-এর সহযোগীদের কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষণ রয়েছে। বুধবার পুলিশ স্থানীয় একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর এক সদস্যকে আটক করে, যে আইএস-এর নামে ইন্টারনেটে হত্যার হুমকি ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত। মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালত সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করেছে। এদের একজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে আইএস-এর আঞ্চলিক সমন্বয়ক হিসেবে। জানুয়ারিতে যখন তাদের আটক করা হয়, তখন তাদের ল্যাপটপে আইএস-এর প্রচারপত্র ও জিহাদি ভিডিও পেয়েছিল।
সরকার এর আগে হামলার দায় চাপিয়েছিল হাসিনার প্রতিপক্ষদের ওপর। একটি তত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল যে, হামলাগুলো পরিচালিত হয়েছে দেশটির চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করার উদ্দেশ্যে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত নৃশংস অপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে ট্রাব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তবে ট্রাইব্যুনালকে পক্ষপাতদুষ্টতার দায়ে ব্যপক সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রবিবার সকালে দুই জন দ-িত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশের অবরুদ্ধ বিরোধী দল বিএনপি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, এটা একটা স্থুল মিথ্যা। ২০১৪ সালে বিতর্কিত একটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ওই নির্বাচনে হাসিনা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা পলাতক কিংবা হাসিনা সরকারের হাতে আটক।
প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশটি ব্যপকভাবে আধুনিকায়িত হচ্ছে। কৃষি ও উঠতি গার্মেন্ট শিল্পের বদৌলতে দেশটির অর্থনীতি প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই মধ্যপন্থী ইসলামকে গ্রহণ করেছে দেশটি। কিন্তু এরপরও দেশটিতে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থকদের মধ্যে সবসময়ই একটি বিভাজন ছিল। সংঘাত এ দেশে হয় রাস্তায়, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও হরতাল সহিংস হয়ে উঠে।
গোপন চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব ১৯৯০’র পর থেকেই ছিল, যখন আফগানিস্তান থেকে জিহাদি যোদ্ধারা দেশে ফেরত এসেছিল, বললেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স¤পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক আবদুর রব খান। ২০০৫ সালের আগস্টে একই দিনে সারা দেশে শ’ শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় একটি জঙ্গি সংগঠন। এর পর থেকেই ছোট আকারের এ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্কে হানা দিয়ে আসছে সরকার। আবদুর রব বলেন, এ দেশে অবশ্যই জঙ্গিবাদ আছে। আমরা দাবি করতাম, এগুলোর বেশিরভাগই দেশীয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। মনে হচ্ছে, পরস্থিতি পাল্টাচ্ছে। যদিও আইএস-এর শারিরীক উপস্থিতি এখানে নেই, কিন্তু এখানে তাদের সমর্থক রয়েছে। তারা আইএস-এর নিয়ন্ত্রণাধীন।
আল কায়দার লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের চার জনকে সরকার ব্লগার হত্যার দায়ে আটক করেছে। অথচ, এরপরও দেশের বহু নেতৃত্বাস্থানীয় বুদ্ধিজীবী আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন। এদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে নজরে পড়ে যাওয়া বা কোন হিটলিস্টে নিজের নাম উঠে যাওয়ার ভয়ে কর্মকা- গুটিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আবদুর রব খান নিজেও নিয়মিত সান্ধ্যকালীন টক শো’তে হাজির হতেন, কিন্তু এখন তিনি তা করেন না বললেই চলে।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় সন্ধ্যা নেমেছে। ঢাকার বাসিন্দারা শহরের পুনঃসংস্কারকৃত হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি লেকের ধারে হাঁটছেন। কয়েক বছর আগে ওই লেক উদ্বোধন করা হয়েছে। নব-নির্মিত এ স্থাপনায় বহু রঙের বাতি জ্বলছে। পার্কের বেঞ্চে মানুষজন হাত ধরে রেখেছে একে অপরের, ভ্রাম্যমান বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনেছে মশলাদার স্ন্যাক ও ক্যান্ডি। দেশের সর্ববৃহৎ ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারের স¤পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, ঢাকা উদ্দীপনায় ভরপুর একটি শহর। তাই জীবন এগিয়ে যায়। কিন্তু ওই ঘটনাগুলো খুবই উদ্বেগজনক। হঠাৎ করেই পুরো সমাজকে অরক্ষিত দেখাচ্ছে। কিভাবে এর জবাব দেব, তা নিয়ে আমরা লড়ছি।
লেকের ধারে মানুষের আনাগোনা এখন স্বাভাবিকের চেয়ে কমেছে বলে জানালেন রুবেল ইসলাম (২৬)। তিনি বলেন, এখানকার একটি জায়গায় তিনি বন্ধুদের নিয়ে সচরাচর রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত আড্ডা দিতেন। কিন্তু হামলাগুলোর পর থেকে তিনি কখনই একা হাঁটাচলা করেন না। অন্ধকার ঝেঁকে ধরার আগেই তিনি বাড়িতে ফেরেন। পাশের একটি কলেজের গণিতের প্রভাষক একেএম নাজিমুদ্দিন (২৮) পানিতে পড়া আলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ধরে আছেন স্ত্রী ফারজানার হাত। তিনি জানালেন, এটা সুন্দর একটা সন্ধ্যা ছিল। কিন্তু এ অনুভূতি বেশিক্ষণ টিকবে না। কারণ, তার ভাষায়, ‘যেকোন সময় যেকোন কিছু ঘটে যেতে পারে’।
[অ্যানি গোয়েন ওয়াশিংটন পোস্টের ভারত ব্যুরো চীফ। এ লেখাটি ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ।]

No comments

Powered by Blogger.