‘সামান্য’ কিন্তু সামান্য নয় by মাহবুবুর রহমান

২রা সেপ্টেম্বর, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক থেকে টার্কিশ এয়ারে ঢাকা আসছিলাম ইস্তাম্বুল হয়ে। ইস্তাম্বুল সময় সন্ধ্যা ৭টায় বিমানটি ঢাকার উদ্দেশ্যে টেকঅফ করলো। টার্কিশ এয়ার লাইন্সের এয়ার বাস ৩৩০। জানালা দিয়ে দেখছিলাম শহরটি। সুন্দর দালান কোঠা, ব্যস্ত রাজপথ, সেতু, নদী, সমুদ্র। প্রাচীন মনোরম শহর ইস্তাম্বুল। পাশে বসা লুফথানসা’র বাঙালি কর্মকর্তা বললেন- ঐ দেখুন বসফরাস প্রণালী। ওটির ওপারে ইউরোপ আর এপারে এশিয়া। বসফরাস প্রণালীর কথা অনেক শুনেছি। দেখার আগ্রহও কম নয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। বিমান ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকলো। এক সময় আকাশ ছাড়া কিছু দেখা গেলো না। লুফথানসার ভদ্রলোক আমার আসনের সামনের টিভি স্ক্রিন সচল করে দিয়ে বললেন, এই বিমানের  ইস্তাম্বুল-ঢাকা রুটের সব তথ্য এখানে দেখতে পাবেন। দেখলাম, আসলেও তাই। সে মুহূর্তে ৩৭ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। গতি ঘণ্টায় ৫১৪ মাইল। ঢাকা পৌঁছতে সময় লাগবে ৭ ঘণ্টা। ভোর ৪টা ৪৪ মিনিটে ল্যান্ড করবে শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একটা ম্যাপে যাত্রা পথ পুরোটা দেখানো হয়েছে। বিমানটি এখন কোথায় আছে, কত উচ্চতায়, গতিবেগ, আর কত সময় লাগবে সব তথ্য স্ক্রিনে ভেসে আসছে। দেখলাম বিমানটির যাত্রাপথে আছে তুরস্ক, লোহিত সাগর, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারত। লুফথানসার ভদ্রলোক বললেন রুটটি দেখুন, সবগুলো দেশই গোলযোগপূর্ণ। তিনি তার একমাত্র কন্যাকে নেদারল্যান্ডসের এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দেশে ফিরছিলেন।
ভদ্রলোককে বললাম, দেখুন ইস্তাম্বুল নিয়ে আমার অনুভূতি অন্য জায়গায়। গভীর সুন্দর এক অনুভূতি। খবরে দেখেছিলাম, সর্বপ্রথম প্রণীত পবিত্র কোরআন শরীফের ৩টির একটি ইস্তাম্বুলে রয়েছে। অপর দু’টির একটি আছে তাসখন্দে। অন্যটি কোথায় এ মূহূর্তে মনে পড়ছে না। আমার কথা শুনে লুফথানসার ভদ্রলোক বললেন, শুধু তাই না। আরও আছে। আমাদের প্রিয় নবী করিম (সাঃ) এর ব্যবহৃত অনেক জিনিস ইস্তাম্বুলে আছে যা দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক আসেন। নমরুদকে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয় সে জায়গাও ইস্তাম্বুলে। হেলেনের ট্রয় নগরীও এখানে। আমি বললাম, এবারতো সম্ভব হলো না। আল্লাহ্‌ তৌফিক দিলে আগামীতে এখানে আসবো এসব দেখার জন্য।
স্ক্রিনে দেখলাম বিমানের গতি নেমে এসেছে ৪৯৫ মাইলে। এখনো রয়েছে তুরস্কের আকাশে। এক এয়ার হোস্টেস হাতে দিয়ে গেলেন মেন্যু। খাবার ও পানীয় কি কি আছে তার বিবরণ। খুলে তা পড়তে লাগলাম। মনে একদিকে ইস্তাম্বুলের সুখস্মৃতি অন্যদিকে আছে কিছু বেদনা। এ বেদনার কারণ এক শ্রেণীর বাঙালি যাদের ‘সিভিক জ্ঞান’ বলতে কিছুই নেই। সে কথায় আসছি পরে।
টার্কিশ এয়ার লাইন্সে এই আমার প্রথম ভ্রমণ। এর আগে নিউ ইয়র্ক-ঢাকা ভ্রমণ করেছি বাংলাদেশ বিমান ও বৃটিশ এয়ারওয়েজে। বছর খানেক আগে আমার স্ত্রী ও কন্যা টার্কিশ এয়ারে বাংলাদেশ সফর করেছেন। তারা নিউ ইয়র্ক ফিরে এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। আমার স্ত্রী বললেন, ওরা একটু পর পর খাবার ও পানীয়তে আপ্যায়িত করে। আর আসনের টিভিতে খবর ও মুভি দেখা যায়। আমিতো নিউ ইয়র্ক-ইস্তাম্বুল রুটে তিনটি ও ইস্তাম্বুল-ঢাকা রুটে ২টি মুভি দেখেছি। কিভাবে যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারিনি।
অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ডিজিটাল জ্ঞান আমার খুব কম। তাই শুধু বিবিসি ওয়ার্ল্ড ও ইউরো নিউজ কিছু সময়ের জন্য দেখার সুযোগ হয়েছিল।
আর খাবার? আমার কাছে এখন বাংলাদেশ বিমানকেই ‘বেস্ট‘ মনে হয়। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি বা লোকসানের পরও বলা যায়, আকাশে বাংলাদেশ বিমানের যাত্রীসেবা এখনো সেরা। এক সময় নিউ ইয়র্ক-ঢাকা রুটে সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট চলাচল করতো। জেএফকে এয়ারপোর্টে বিমানের নিজস্ব স্পটও ছিল। এখন কিছুই নেই।
বিমানটি একটু একটু ঝাকি দিচ্ছিল। ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে ভেসে এলো সিট বেল্ট বাঁধার জন্য অনুরোধ। সম্ভবত: বিরূপ আবহাওয়া মোকাবিলা করে করে প্লেনটি এগুচ্ছিল। স্ক্রিনে দেখলাম এর গতি আরও একটু কমেছে। দু’-একজন ছাড়া সম্ভবত: যাত্রীদের সবাই বাঙালি। পাশের আসনের এক যুবক তার পেছনের যুবককে তাগাদা দিচ্ছিল হুইস্কির অর্ডার দেয়ার জন্য। বেশি বেশি করে। অনেককেই দেখলাম হার্ডড্রিংকসে নিজেদের ডুবিয়ে দিতে।
আরেকটি বিষয়, একই বাঙালি একে-আপরের সঙ্গে কথা বা আচরণে যে জড়তা বা হীনমন্যতা ভর করে না, একজন সাদা বা কালোর মুখোমুখি হলে ঘটে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অজানা কোন ভীতি অথবা কেমন এক জড়তা বা আড়ষ্টতা চোখে পড়ে। কেন এ মনস্তত্ত্বিক সমস্যা?
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে মিশিগানের হ্যামট্রামিক সিটির সাহাব আহমদ সুমিনের কথা। তরুণ সুমিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশী কাউন্সিলম্যান। এক সাক্ষাতে আমাকে বলেছিলেন, এখানের রাজনীতিতে প্রথম যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো, আপনি কে? দেশকে দেয়ার জন্য কি যোগ্যতা বা সামর্থ্য আপনার আছে। মেধা, শিক্ষা, অর্থ এর কোন না কোন একটা আপনার থাকতেই হবে। আর অভিবাসীদের বড় এক সমস্য হলো মনস্তাত্ত্বিক। একজন সাদা বা কালোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার আগেই আমরা হেরে যাই। নিজেকে ছোট ভাবি। এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে আমরাও পারি।
হ্যাঁ, পেরেছেন লন্ডনের রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিকী, রূপা হক অথবা ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ওবামার উপদেষ্টা নীনা আহমদ। সাফল্যের ইতিহাস আরো আছে। বাঙালি বিজ্ঞানী, ডাক্তার, শিক্ষক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ দেশে দেশে ছড়িয়েছেন সুনাম। তারা ভয়কে করেছেন জয়। আর কেনই বা করবেন না। যে জাতি একাত্তরে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, যে জাতি বীরের জাতি, যার জনক বঙ্গবন্ধু-সে জাতি বাধার পাহাড় ডিঙাবে সেটাইতো স্বাভাবিক। মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর ইমেজের কথা। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মাঝে তার উপস্থিতি ছিল অনবদ্য। জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ সম্মেলেন, ওআইসি বা দ্বিপক্ষীয় সম্মিলন সবখানেই বঙ্গবন্ধু থাকতেন মধ্যমণি হয়ে। কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, কি অসাধারণ নেতৃত্ব ছিল তাঁর। তাই বঙ্গবন্ধুর দেশের মানুষকে কাবু করবে ভয়- তা মেনে নেয়া যায় না।
লেখক: নিউ ইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.