আইএস সমর্থকরাই হত্যা করেছে সিজারকে

ঢাকায় ইতালিয়ান এনজিওকর্মী সিজার তাভেলাকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত সমর্থকরা হত্যা করে থাকতে পারে। ওই হত্যাকারীরা আইএসের সক্রিয় সদস্য নাও হতে পারে। এমনটিই ধারণা করছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সিজার তাভেলাকে অনুসরণ করে হত্যা করার যে দাবি আইএস করেছে, তাতেও বিস্মিত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এ খবর দিয়েছে অনলাইন টাইমস অব ইন্ডিয়া। এক জ্যেষ্ঠ ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে আইএসের সরাসরি উপস্থিতির বিষয়ে কোন নিরেট প্রমাণ নেই। কিন্তু দেশটিতে উদ্বেগজনক মাত্রায় উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর বিস্তার ঘটছে, যারা সন্ত্রাসবাদের পরিষ্কার হুমকি তৈরি করছে। ইতালিয়ান নাগরিকের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি হয়তো আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল কারও একাকী বিচ্ছিন্ন হামলা।
ভারতীয় ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভারতেও এ ধরনের হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি। ভারতে অনেক তরুণের মধ্যে আইএসের প্রতি আগ্রহ দেখা গেছে। অনলাইনেও আইএসের প্রতি সমর্থন দিতে দেখা গেছে কিছু তরুণকে। সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বর্তমানে প্রায় ১০ ভারতীয় তরুণ রয়েছে। ২৫-৩০ তরুণ এ জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে গোয়েন্দাদের তৎপরতায় ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১০ তরুণকে কেরালায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। সিরিয়ায় আইএসের সক্রিয় সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাদের।
এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আইএসের সহিংস চরমপন্থি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মৌলবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের হামলার পরিষ্কার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতে এদের অনেকেই বিচ্ছিন্ন হামলা চালানোর চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক রয়েছে। এ ধরনের সন্দেহজনক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষকে সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের অনলাইন বার্তা আদান-প্রদানের দিকে নজর রাখা হচ্ছে। ইরাক ও সিরিয়ায় গমন কিংবা আইএসে যোগদানের লক্ষণ দেখা যাওয়া মাত্রই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হস্তক্ষেপ করছে।
ঢাকায় এ ধরনের একাকী হামলার ঘটনায়, ভারতেও একই ধরনের হামলা ঘটার আশঙ্কাকে আরও যুক্তিযুক্ত করেছে। কিন্তু আইএস যেভাবে তাদের হাতে আটক বিদেশীদের হামলা চালায়, ঠিক সেভাবে ইতালিয়ান কর্মীকে ঢাকায় হত্যা করা হয়নি। এটিও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সন্দেহের অন্যতম কারণ, আইএসের সক্রিয় সদস্যরা এ হামলায় সরাসরি জড়িত না থাকলেও, আইএসের মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ এ হামলা চালিয়েছে।
চার দিনেও তদন্তে ‘দৃশ্যমান অগ্রগতি’ নেই
কূটনৈতিক পাড়ায় ইতালিয়ান নাগরিক খুন হওয়ার চারদিন পার হতে চলছে। এ পর্যন্ত তদন্তে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। পুলিশ এখনও হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বা ক্লু কিছুই উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে জঙ্গি গোষ্ঠী নাকি আন্তর্জাতিক কোনও অপরাধী চক্র জড়িত রয়েছে তাও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটির তদন্ত করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা খুনিদের শনাক্তে চেষ্টা করছে। চলছে চতুর্মুখী তদন্ত। প্রাথমিকভাবে পাওয়া বিভিন্ন রকম তথ্যগুলি চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ইতালিয়ান নাগরিক তাবেলা সিজারের ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এর সঙ্গে জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠি না হলেও দেশীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এগার সদস্যের তদন্ত সহায়তা দলের প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলছেন, সিজার হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে কোনও কিছুই বাদ দেয়া হচ্ছে না। প্রতিটি বিষয় ধরে ধরে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন পুলিশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। যে কোন মূল্যে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। তবে একটু সময় লাগবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতালিয়ান নাগরিক সিজার আইসিও নামে যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তারা চার্চ সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। খুনের নেপথ্যে চার্চ সংক্রান্ত কোনও বিষয় আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিজারের বান্ধবীসহ সহকর্মী ও যেই বাসায় থাকতেন সেই বাসার প্রতিবেশীসহ বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ধারণা নেয়া হচ্ছে খুনিদের চেহারার। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সম্ভাব্য খুনিদের মুখচ্ছবি আঁকার চেষ্টা করছেন। তাছাড়া অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে তথ্য জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়াও নিযুক্ত করা হয়েছে গুপ্তচর। গুপ্তচরেরা বের করার চেষ্টা করছে পেশাদার কোনও কিলার গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা।
তদন্ত সূত্র জানায়, এরই মধ্যে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা গুলশান এলাকার সকল ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। একটি মাত্র ক্যামেরায় দু’টি মোটরসাইকেলকে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। তবে মোটরসাইকেল আরোহীদের চেহারা অস্পষ্ট। মোটরবাইকটি পালসার ব্র্যান্ডের বলে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। তবে অন্ধকারের কারণে এটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর জানা যায়নি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঘটনার আগে ও পরে ঘটনাস্থলের আশেপাশের মোবাইল কললিস্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। কয়েক হাজার মোবাইলের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখছে পুলিশ। সেখান থেকে সন্দেহজনক কলারদের আলাদা তালিকা করা হচ্ছে। সেগুলো আবার যাচাই বাছাই করা হবে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, নারী ঘটিত বা ব্যক্তিগত কোনও বিরোধের কোনও ক্লু তারা এখনো খুঁজে পাননি। খুবই সাধারণভাবে চলাফেরা করতেন নিহত ইতালিয়ান নাগরিক সিজার। ওই কর্মকর্তা জানান, তারা মনে করছেন এর নেপথ্যে জঙ্গিদেরই হাত রয়েছে। তবে তৃতীয় কোনও পক্ষও এই সুযোগ নিতে পারে। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলামও এই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ইতালিয়ান নাগরিককে হত্যার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কোন চক্রান্ত আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মনিরুল ইসলাম জানান, ইতালীয় নাগরিক তাভেলা হত্যাকাণ্ডের এখন পর্যন্ত কোন সুস্পষ্ট কোন মোটিভ পাওয়া যায়নি। তবে তিনটি মোটিভকে কেন্দ্র করে তদন্ত চলছে। ওই তিনটি বিষয় হচ্ছে, ব্যক্তিগত, এনজিও-কেন্দ্রিক ও আইএস নিয়ে। গতকাল দুপুরে তিনি গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কের ঘটনাস্থলে সরজমিন দেখতে গিয়ে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের একথা জানান। মনিরুল ইসলাম বলেন, এটা একটা বিছিন্ন ঘটনা। খুনের ঘটনার তিন দিন পার হতে চলেছে। মামলা দায়ের হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু কি কারণে ওই ইতালি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে তার কোন ক্লু পায়নি পুলিশ। তবে ক্লু উদঘাটনের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই হত্যার বিষয়টি খুব সংবেদনশীল। তদন্তের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। মনিরুল ইসলাম বলেন, খুনের ধরন দেখে প্রথমেই মনে হয়েছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পেশাদার খুনিরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। খুনের কারণ জানা ও খুনিদের গ্রেপ্তারের জন্য মাঠে একাধিক গোয়েন্দা দল কাজ করছে। মনিরুল ইসলাম জানান, গুলি করার সময় কোন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে খুনিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে খুনিদের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নেয়া হয়েছে।
গতকাল দুপুরে হত্যাকাণ্ডের স্থান গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কে গিয়ে দেখা যায়, ওই স্থানটি পুলিশের ক্রাইম সিনের ফিতা দিয়ে এখনো ঘেরাও করে রাখা রয়েছে। সেখানে পথচারী ও উৎসুক মানুষের ভিড়। ওই এলাকার রাস্তার যান ও লোকজন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, ডিবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন দায়িত্ব পালন করছেন। পুরো গুলশান-বনানী এলাকায় আগের চাইতে কয়েকগুণ বেশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এলাকায় কোন সন্দেহভাজন ব্যক্তি দেখামাত্র তাদের দেহ ও গাড়ি তল্লাশি করা হচ্ছিল। ডিবি’র কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ টিমকে ওই এলাকায় টহল দিতে দেখা গেছে। গুলশান-২ নম্বর এলাকায় রাস্তায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে প্রায় ২৭টি নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে। ওই এলাকায় প্রতিটি রাস্তায় প্রবেশ ও বের হওয়ার স্থানগুলোতে নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে। পুরো এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অতন্ত সতর্ক অবস্থায় থাকতে দেখা যায়। ঘটনার পর থেকেই ওই এলাকায় খুব কম বিদেশী নাগারিকদের দেখা গেছে। তবে ঘটনাস্থলে বিদেশী সাংবাদিকদের অনেকেই তথ্য সংগ্রহ করছিলেন।
উল্লেখ্য, গত সোমবার সন্ধ্যায় সাড়ে ৬টার দিকে গুলশান ২ এর ৯০ নম্বর সড়কে ইতালিয়ান নাগরিক তাভেলা সিজারকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত সিজার আইসিসিও কো-অপারেশন নামে একটি সংস্থার প্রুফ (প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.