তাকে কেউ আর মনে করে না by পীর হাবিবুর রহমান

হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী
আমরা কেউ তাকে আর মনে রাখি না। এমনকি যে রাজনৈতিক দলে থেকে জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেই দলও না। দক্ষিণ এশিয়ার জাঁদরেল কূটনীতিক, পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কথা বলছি। আজ ১০ জুলাই তার মৃত্যুবার্ষিকী। সিলেট অন্তপ্রাণ এই মহান মানুষটির স্মরণে স্থানীয়ভাবেও কোন আয়োজন নেই। অথচ সিলেটের উন্নয়নে তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষ। রাজটিকা কপালে নিয়ে জন্মেছিলেন সুনামগঞ্জের এক অভিজাত পরিবারে। মানুষের কল্যাণে তার হৃদয়খানি ছিল খোলা। সিলেটের অনেকেই তার আনুকুল্য নিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পরিবার পরিজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করার পর বাংলাদেশে এক অন্ধকার বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নেমে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর দুইকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। যেখানে শিশুপুত্র রাসেলকে ঘাতকরা রেহাই দেয়নি, সেখানে মুজিব কন্যারা দেশে থাকলে খুনিচক্র রেহাই দিত না। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ছিলেন দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সর্মথন। সেই আগস্টের কালো রাতে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ছিলেন পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। বঙ্গবন্ধুই তাকে সেখানে পাঠিয়ে ছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট বন্ধু সানাউল হককে বেলজিয়ামে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন। সেই রক্তার্ক্ত আগস্টের দিনে গোটা পরিবার হারানো বেদনায় শোক বিহ্বল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী মরহুম ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া। কিন্তু সানাউল হক সেদিন চোখ পাল্টে ছিলেন। জাতির জনকের কন্যাদের তার বাড়িতে আশ্রয় দিতে চাননি। অসহায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত দুইকন্যাকে যার জার্মান পাঠিয়ে দিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোন করেছিলেন সানাউল হককে। সেখান থেকে সানাউল হক তার গাড়িটি পর্যন্ত দেননি সীমান্তে আসার জন্য। কিন্ত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জার্মান সীমান্ত থেকে গাড়ি পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যাদের তার কাছে এনেছিলেন। সেখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গেও তাদের দেখা হয়েছিল। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও তার স্ত্রী গভীর সমাবেদনা ও মমতা নিয়েই তাদের পাঁশে দাঁড়াননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধির সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কারণ তার জার্মানের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর দুইকন্যা আছেন শুনে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়া জাসদের কর্মীরা হামলা করেছিল। জার্মান পুলিশ ডেকে তিনি তাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে অবৈধ খুনি মোশতাক সরকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় তলব করেছিলেন।
দীর্ঘ কূটনীতিক জীবনের চাকুরি শেষে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ও পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। সৌদি রাজ পরিবারের আপনজন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আরব দুনিয়াও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি সিলেটের হযরত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়টি আদায় করেছিলেন সেনাশাসক এরশাদের কাছ থেকে। এরশাদের ভূমিমন্ত্রী হয়েছিলেন সাবেক আইজিপি মরহুম এমএ হক। কিন্তু এমএ হক সিলেট গেলে মানুষের চেয়ে পুলিশের উপস্থিতি থাকত বেশি। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার পর সিলেট পৌরসভার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফম কামালকে তার সঙ্গে টানেন ব্যক্তিগত সর্ম্পকের সুবাদে। সিলেটের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সিলেটে তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। এরশাদ সিলেটে নামতে পারছেন না। কারাবন্দি ও কারামুক্ত নেতাদের সঙ্গে আফম কামালকে দিয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদকে সিলেট নিয়ে প্রথম জনসভা করান। আর বিনিময়ে এরশাদ সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং নগরীর উন্নয়নে পৌরসভায় এককোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন। অথচ সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি হল বা ভবন তার নামে আজও প্রতিষ্ঠা করেনি। '৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সিলেট সদর ও সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে বিজয়ী হন। প্রতিনিধিত্ব করেন সিলেট সদর থেকে। '৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার অনুরোধে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদেন। ওই নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে সিলেট সদরে তিনি আরেক কৃত্বি সন্তান মরহুম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে পরাজিত করেন। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে '৭৩ সালের পর এই আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে তার ঘাঁটি শক্তিশালী করে এবং একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তাকে সপ্তম সংসদে স্পিকার নির্বাচিত করা হয়। উচ্চশিক্ষিত দিল দরাজ উদার ভদ্র বিনয়ী এই মানুষটি সংসদ পরিচালনায় দক্ষতাই দেখাননি। তিনি সবকটি মোনাজাত নিজে পরিচালনা করতেন। আরবী, ফার্সি, বাংলা মিলিয়ে করা তার মোনাজাত সংসদকে তন্ময় করে দিত। তরুণ বয়সে বোম্বে চলচ্চিত্রের অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন এই সুদর্শন মানুষটি। পেশার তারে জড়ানো জীবনে সংসদ কাভার করতে গিয়ে তার স্নেহসান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছিল। বলা যায়  পুত্রস্নেহ লাভ করেছিলাম তার কাছে। তিনি আমাকে আইপিইউ-এর জর্ডান কনফারেন্সে পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের সঙ্গে সফরসঙ্গী করেছিলেন। সেইকটা দিন ছিল আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ। অতন্ত সৌখিন, স্মার্ট, অভিজাত এই রুচিশীল মানুষটিকে দেখেছি কাছ থেকে। আমার ছেলে অন্ত ছোট বেলায় তার সংসদের কার্যালয়ে যেত। তিনি তার জন্য আলাদা বিস্কুট রাখতেন। আপনি করে তাকে সম্বোধন করায় বলেছিলাম, "স্যার এই বাচ্চা শিশুটিকেও যদি আপনি বলেন তাহলে কিভাবে হয়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন আমরা যদি আপনি না বলি তিনি শিখবেন কি করে।"
আমার একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখা এমন বনেদি মানুষ দু'চারজনের বেশি চোখে পড়েনি। জর্ডানের সেই কনফারেন্সে অনেকগুলো ডিনারে আমরা অংশ নিয়েছি। তিনি আমাদের বলতেন দুনিয়ার প্রায় সব দেশ থেকে পার্লামেন্টারিয়ানরা এসেছেন। আপনারা যান, আপনাদের এখন লবিং করার বয়স। আমার পড়ন্ত কাল আমি রুমেই রাতের ডিনার সেরে নেব। সাতপাহাড়ের নগরী আম্মানের রেডিসন সাস হোটেল থেকে যখনই নামতেন খাবার জন্য আমাকে তার পাশে চাই। রেস্টেুরেন্টে নিয়ে ম্যানু ধরিয়ে বলতেন আপনি আপনার মতো অর্ডার দেন। আমি আমার মতো অর্ডার দেব। খাব সবাই মিলে। কোরআন শরীফ দারুন তেলাওয়াত করতেন। তর্জমা জানতেন। কোরআনে উল্লেখিত অনেক ঘটনাস্থল তিনি আমাদের ঘুরিয়েছেন। ভ্রমণ পিপাসু মানুষটি হাত ধরে জর্ডানের সেই ডেড সী বা লুত নদী দেখিয়েছিলেন। মাউন্ড নেভোতে দাঁড়িয়ে দেখিয়েছিলেন ওপারে ইসরাইল। হযরত মুসা (আঃ) ইসা(আঃ) জন্মের আগে হন্যে হয়ে খুজঁছিলেন কোথায় জেরুজালেম। মুসা যেখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর গায়েবি আদেশ শুনলেন। ওই দ্যাখ জেরুজালেম। কিন্তু তুমি সেখানে যেতে পারবে না। সেই জায়গাটিতেই দাঁড়িয়েই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের অনেক গল্প শুনাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে জুলিয়াস সিজারের দূর্গ খ্যাত জেরাস শহর ঘুরিয়ে এনেছিলেন। সেন্স অব হিউমার তার ছিল প্রবল। তার হোটেল কক্ষে একদিন সুলতান মুনসুর, পান্না কায়সার, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফসহ আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় সাদা ব্র“ক্যাটের শেহরওয়ানি সেটের সঙ্গে সাদা জুতো পরে প্রবেশ করলেন নওগাঁর বিএনপি দলীয় এমপি শামছুল আলম প্রামানিক। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাকিয়ে শুধু বললেন এখন দরকার একজন পাত্রী, একটি পাগড়ি আর একখানি রুমাল। আমরা সবাই হাসলাম। তার হৃদয়খানি দেহের চাইতেও বড় ছিল। সংসদ সদস্যরা দেশের বাইরে ডেলিগেশনে গেলে সংসদ সচিবালয়কে তিনি বলতেন কতবেশি টাকা তাদের দেয়া যায় দেখেন। সংসদ চলাকালীন বিএনপি দলীয় যেসব এমপি তার দিকে ফাইল ছুঁড়েছেন গালিগালাজ করেছেন তাদের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন উদার। তাই আড়াঁলে তার অফিসকক্ষে গিয়ে অনেককেই দেখতাম শ্রদ্ধায় তাকে কদমবুচি করতে। জর্ডানের সেই সফরে একরাতে পছন্দের রেস্তোরায় গেলাম ডিনার সারতে। তার সঙ্গে আমি ও তার একান্ত সচিব আজকের রাজ্বস বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বসলাম। উচ্চশিক্ষিত, সৎ বিনয়ী নজিবুর রহমান তার শক্ত ইংরেজি ভাষার ডিকটেশন নিতেন সহজভাবে। ফাইল ওর্য়াক করতেন। অন্যদিকে হাসিমুখে তার অতিথিদের আপ্যায়ন করাতেন। নজিবুর রহমানকে তিনি অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে পাঠিয়েছিলেন গবেষণায়। তাই নয় এই সৎ মানুষটি যাতে বাড়তি উর্পাজন করতে পারেন সেজন্য তিনি ওভার টাইম কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। রাত নয়টা দশটা পর্যন্ত তিনি অফিস করতেন। সেই রাতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের এমপিরা বিভিন্ন টেবিলে খেতে বসেছেন। আমাদের খাবারের মধ্যে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বললেন, যখন ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। তখন এক দুপুরে রেস্টেুরেন্টে ঢুকেছি খেতে। অনেক কিছু খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পকেট হাতড়ে হিসেব করেই অর্ডার দিলাম। খাওয়া শেষে এক মুরুব্বি এসে গল্প জুড়ালেন। পরিচয় নিলেন। বিল দেয়ার সময় দিতে আর দিলেন না। বললেন দেশের ছেলে পড়ালেখা করছেন। বিল কিসের। রেস্টুরেন্টের মালিকও একজন সিলেটি। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলছিলেন তখন তার মনে হয়েছিল যদি জানতেন তাহলে ইচ্ছা মতো অর্ডার দিতেন। খাবার শেষে ওয়েটারকে ডেকে বললেন অন্যান্য সব টেবিলের বিল তিনি দেবেন। বিল দানের পর বাংলাদেশের সব এমপিরা এসে বলছিলেন স্যার। আগে বলবেন না আপনি খাওয়াবেন। তাহলে আমরা হিসাব না করে অনেক কিছুর অর্ডার দিতাম। এই মানুষটি আমাকে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম সেশন কাভার করতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য করে। সেবার নেশন প্লাজা হোটেল থেকে তার স্ত্রীসহ লিফটে নামছি। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির বাসভবনে ডিনারে যাব। লিফটে এক যুগল উঠেছে। তরুণটির চাইতে তার গার্লফেন্ড্রের বয়স অনেক বেশি। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী বললেন এত সুন্দর ছেলে এই বুড়ির সঙ্গ নিল কেন? ওপরের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জবাব দিলেন গণতন্ত্রের দেশ।
পীর হাবিবুর রহমান
সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ ছিল এক অবহেলিত জনপদ। যোগাযোগ বলে কিছুই ছিল না। ছিল না স্বাস্থ্য, শিক্ষার ব্যবস্থা। এই থানাকে নিজে গড়ে গেছেন স্বপ্নের মতো। এই গুণী মানুষটিকে তার পরিবার বা দল কেউ স্মরণ করে না। তার জন্মদিন অথবা মৃত্যুবার্ষিকীতেও। তার কন্যা নাসরিন রশীদ করিমের ক্যানসারে আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় কেউ আর কোন স্মরণ সভারও উদ্যোগ নেয় না। এখনও শাহজালালের মাজারে গেলে আমি তার কবরখানি জিয়ারত করে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করি এই সম্মানিত মানুষটির জন্য তুমি জান্নাতের দরজা খুলে দাও।

No comments

Powered by Blogger.