বঙ্গবন্ধুকে ছাপিয়ে ‘নেতা’দের আত্মপ্রচার

জাতীয় শোক দিবসের প্রচারে বঙ্গবন্ধুকে ছাপিয়ে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ছবির ভিড়। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে টানানো বিলবোর্ড ও ব্যানারে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরার চেয়ে নিজেদের ছবি ও নাম-পদবি প্রচারের দিকেই বেশি ঝোঁক তাঁদের। ছবিগুলো যথাক্রমে খামারবাড়ি, মধ্য বাড্ডা, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর মোড় এবং বেইলি রোড এলাকা থেকে গতকাল তোলা l আলোকচিত্র: সাবিনা ইয়াসমিন ও আবদুস সালাম
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪০তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীজুড়ে শোভা পাচ্ছে শত শত পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড। কোথাও কোথাও সড়ক-ফুটপাতে সুবিশাল তোরণ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এ আয়োজন। তবে বঙ্গবন্ধু যেন উপলক্ষমাত্র। আসল উদ্দেশ্য ‘নেতা’দের আত্মপ্রচার।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গাবতলী, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, আজিমপুর, মহাখালী, গুলশান, বাড্ডা, তেজগাঁও, মগবাজার, রমনা, মতিঝিল এলাকা ঘুরে পোস্টার-ফেস্টুন দেখেছেন প্রথম আলোর চার প্রতিবেদক।
দেখা গেছে, এসব পোস্টার-ফেস্টুনে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে ছাপিয়ে ছোট-বড় নেতাদের আত্মপ্রচারই বড় হয়ে উঠেছে। দল বা সংগঠন নয়, ব্যক্তি উদ্যোগে দেওয়া বেশির ভাগ পোস্টার-ব্যানারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি স্থান পেয়েছে ওপরে বাঁ পাশে এক কোনায় ছোট করে। প্রচারকারীর নিজের এবং তিনি যাঁর অনুসারী, তাঁর বা তাঁদের ছবি আছে বিশাল অংশজুড়ে।
ব্যানার-পোস্টারের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নির্দেশনা আছে কি না, জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলীয় সভায় বলা হয়েছে, শোক দিবসের ব্যানার-পোস্টারে যেন শোকের আবহ থাকে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর ছবি ছাড়া অন্য কারও ছবি দিতে নিষেধ করা হয়েছে।’
কিন্তু বাস্তবে ওই নিষেধাজ্ঞা কোনো কাজেই আসেনি। মধ্য বাড্ডায় একটি বিশাল বিলবোর্ডে লেখা, ‘জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম সোহেল ভাইয়ের পক্ষ থেকে সকলকে জানাই ১৫ আগস্টের রক্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি।’ ‘ভাইয়ের’ পক্ষ থেকে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছেন বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মো. রিয়াদ। বিলবোর্ডে মোট তিনটি ছবি। সবচেয়ে ছোট ছবিটি বঙ্গবন্ধুর। আর সবচেয়ে বড় ছবিটি ‘সোহেল ভাইয়ের’। মধ্যখানে প্রচারকারী রিয়াদের ছবি, সেটিও বঙ্গবন্ধুর ছবির চেয়ে বেশ বড়।
এর একটু দক্ষিণে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে চোখে পড়ে আরেকটি ছোট আকারের ফেস্টুন। এখানে ‘রিয়াদ ভাই’য়ের পক্ষ থেকে সবাইকে ১৫ আগস্টের ‘রক্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি’ জানাচ্ছেন ৯৭ নম্বর ওয়ার্ড শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আল আমিন। এখানেও যথারীতি বঙ্গবন্ধুর ছবির চেয়ে অনেক বড় আল আমিনের ছবি। আর তাঁর চেয়ে বড় ‘রিয়াদ ভাইয়ের’ ছবি।
কোথাও কোথাও দেখা গেছে, শোক দিবসের পোস্টারে শোকের কোনো আবহ নেই। ‘১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ শিরোনামের একটি ব্যানারে দেখা গেছে, আহ্বানকারী নিজেই নিজের হাস্যোজ্জ্বল ছবি জুড়ে দিয়েছেন। তিনি রমনা থানার ১৯ নম্বর ওয়ার্ড শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। তাঁর সঙ্গে আরও চারজনের ছবি শোভা পাচ্ছে।
ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ের গলির প্রবেশমুখ ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে ঢেকে গেছে। কার্যালয়টির ফটকের ঠিক সামনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক কে এম কবির হোসেন একটি ডিজিটাল ব্যানার সেঁটেছেন। সেখানে এক কোনায় বঙ্গবন্ধুর ছবি ঠাঁই পেয়েছে। আর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপের নায়কোচিত ছবি বিশালাকারে দেওয়া হয়েছে।
শোক দিবসকে কেন্দ্র করে আওয়ামী তৃণমূল লীগ, প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের মতো নামসর্বস্ব সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও নিজেদের প্রচারে নেমেছেন। এমন অনেকেই পোস্টার-ফেস্টুন করেছেন, যাঁদের কোনো পদ-পদবি নেই। গুলশানে এ রকম একটি ফেস্টুন চোখে পড়ে। ফেস্টুনের ওপরে বাঁ পাশের কোনায় একটি গোলকে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। ডান পাশে বঙ্গবন্ধুর ছবির চেয়ে বড় আকারে যুবলীগের দুই নেতার ছবি। আর নিচে সবচেয়ে বড় ছবিটি মো. হারুন প্রধানের, যিনি ওই ফেস্টুনটি করেছেন। সম্ভবত যুবলীগে তাঁর কোনো পদ নেই। তাই বলে পরিচয় নেই, তা কিন্তু নয়। ফেস্টুনে তাঁর পরিচয় লেখা হয়েছে ‘মো. হারুন প্রধান, যুবলীগ নেতা, গুলশান-১’। গুলশান-২ নম্বর মোড়ে ফেস্টুনটি দেখিয়ে পাঁচ-ছয়জনের কাছে প্রথম আলোর প্রতিবেদক জানতে চাইলেন, এই নেতাকে চেনেন কি না। সবার উত্তর ‘না’। আবদুল আউয়াল নামের একজন দোকানকর্মী বললেন, তিনি ১৭ বছর ধরে ওই এলাকায় থাকেন, কিন্তু ওই নেতাকে কোনো দিন দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।
ওই এলাকায় ১৮ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি পোস্টার দেখা যায়। তাতে আছে বঙ্গবন্ধুর ছবির বাইরে ১২ জনের ছবি। পোস্টারটি এই প্রতিবেদক মনোযোগ দিয়ে দেখছেন দেখে থমকে দাঁড়ালেন এক যুবক। তাঁর মন্তব্য, ‘ছোট হলেও শেখ মুজিবের ছবি যে আছে, এটাই বেশি।’ বাড্ডা হাইস্কুলের ফটকে ঝুলছে এ ধরনের আরেকটি ব্যানার। তাতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ছবির বাইরে ১৪ জনের নামসহ ছবি।
ধানমন্ডিতে আওয়ামী প্রজন্ম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ওমর ফারুক অবশ্য আরও একধাপ এগিয়ে। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি দেওয়ারই প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু নিজের ছবি দিয়েই শোক জানিয়েছেন।
বাড্ডা এলাকায় একটি ফুটওভার ব্রিজজুড়ে ঝুলছে এ রকম অনেক পোস্টার-ফেস্টুন। গুনে দেখা গেল, সব মিলে বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে নয়টি। আর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার ছবি আছে ৪২টি।
রাজধানীজুড়ে পদবিহীন নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের ছবিও চোখে পড়েছে পোস্টার-ফেস্টুনে। কিন্তু আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে পোস্টার-ফেস্টুন সেভাবে চোখে পড়েনি। এমনকি ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানার থাকলেও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোনো পোস্টারের দেখা মেলেনি।
রাস্তায় তোরণ: গাবতলী, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, আজিমপুর ঘুরে অন্তত ২৫টি তোরণ দেখা গেছে। এর মধ্যে গাবতলী, মিরপুর-১ ও মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় অন্তত আটটি তোরণ বানানো হয়েছে। এসব তোরণে প্রচারের জায়গায় ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবাশ্বের চৌধুরী, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী টিপু সুলতান, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আবু তাহের ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ইকবাল হোসেন তিতুর নাম লেখা হয়েছে। আর সব তোরণেই সৌজন্যের জায়গায় স্থানীয় সাংসদ আসলামুল হকের নাম দেওয়া আছে।
জানতে চাইলে আসলামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে তোরণ নির্মাণের জন্য তাঁদের কোনো নির্দেশনা নেই। অতি উৎসাহী অনেকে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এগুলো বানাতে পারে।
দেখা যায়, পাঁচ খুঁটির বিশাল এসব তোরণের দুটি খুঁটি রাস্তার দুই পাশে পড়ায় যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগারগাঁও তালতলা বাসস্ট্যান্ডে এমন একটি তোরণ বানিয়েছিল আগারগাঁও বাজার বণিক সমিতি। তোরণটির একটি খুঁটি ভেঙে রাস্তার ওপর পড়ায় যানবাহন চলতে সমস্যা হচ্ছে।
মতিঝিল এলাকার অধিকাংশ সরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটকে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানের নাম দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া কার্যালয়ের চারদিকে টানানো রয়েছে ব্যানার।
বিজয় সরণির ‘ফাইটার’ নামের উড়োজাহাজটি ঢাকা পড়ে গেছে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে। এখানে বেশির ভাগ ব্যানারই ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরানের নামে। বিজয় সরণিতে একাধিক বিলবোর্ড দখল করে নিজের বিশাল ব্যানার লাগিয়েছেন ফরিদুর।
মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রবেশমুখে বানানো হয়েছে তোরণ আর পুরো প্রবেশমুখ ঢাকা পড়েছে কলেজ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর আত্মপ্রচারমূলক পোস্টার-ব্যানারে। এটি যে একটি কলেজ, তা বোঝার কোনো উপায় নেই।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকায় তোরণ নির্মাণ করেছে ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ। তোরণসংলগ্ন একটি ব্যানারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের ছবি দ্বিগুণ বড় করে ছাপানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.