শিশু ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনে সুশীল সমাজ ও করপোরেট খাতের ভূমিকা

২ জুলাই ২০১৫, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘শিশু ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনে সুশীল সমাজ ও করপোরেট খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: ভিক্ষাবৃত্তি সমাজের অভিশাপ। একটি শিশুর শৈশবকাল ভিক্ষাবৃত্তিতে অতিবাহিত হতে পারে না। আমাদের কারোর এটা কাম্য নয়। এটি মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের লঙ্ঘন। দেশ ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। অথচ সমাজের অসংখ্য শিশু ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করছে। শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।
তবে কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এককভাবে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। পেশাজীবী, সুশীল সমাজ, নীতিনির্ধারক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসই কেবল এই অমানবিক ভিক্ষাবৃত্তি থেকে শিশুদের রক্ষা করতে পারে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র একটি মানবাধিকার সংস্থা। তারা এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। আমাদের সবার উদ্দেশ্য সমাজ থেকে যেন শিশু ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন হয়। এখন এ বিষয়ে আলোচনা করবেন সুলতানা কামাল।
সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল
শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা কেউ চাই না এরা ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করুক। িশশু ভিক্ষাবৃত্তি কারোরই পেশা হতে পারে না। এই কাজ যখন শিশু বয়স থেকে শুরু হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি সমাজে শিশুদের প্রতি কত অবহেলা। এ বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রের একার পক্ষে এটা হয়তো সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে। অনেক সময় ভিক্ষাবৃত্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমস্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়। পুলিশ দিয়ে এদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। হয়তো কোথাও আটকে রাখা হয়, অথবা কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়।
এখানে দেখতে হবে, কেন তারা ভিক্ষা করছে। তাদের কী সমস্যা। কে তাদের এই পথে আনছে। এসব সমস্যা না দেখে অন্যভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। ফলে এই চেষ্টা কাজে আসছে না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র একটা মানবাধিকার সংগঠন। অনেক দিন ধরে আমরা শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তির বিষয়ে কাজ করছি। আমরা দেখেছি, অসংখ্য শিশু ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দারিদ্র৵, নির্যাতনসহ ভিক্ষাবৃত্তির হয়তো বিভিন্ন কারণ রয়েছে। অনেক সময় সংঘবদ্ধ চক্রের কথা শুনে থাকি। বিভিন্নভাবে এরা শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করে।
শিশুসহ কেউ ভিক্ষাবৃত্তি পছন্দ করে না। তারপরও তাকে কেন এটা করতে হয়? এ বিষয়ে সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সমাজ থেকে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। শিশুরা সমাজের অনিয়ম ও বৈষম্যের শিকার। শিশুদের মানসিকভাবে বিকাশের সুযোগের বৈষম্য রয়েছে। দেশে লাখ লাখ কর্মজীবী শিশু রয়েছে। তাদের ৫৫ শতাংশ শুধু ঢাকা শহরে কাজ করে।
কর্মজীবী শিশুদের ৯ শতাংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত; বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসাবে একটি বড় অংশ। তাই এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
গীতা চক্রবর্তী
গীতা চক্রবর্তী
২০১৩ সাল থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত শিশুদের নিয়ে কাজ করছি। দেশের উন্নয়ন সত্ত্বেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কমে যায়নি। এক হিসাবে দেখা যায়, এখনো বাংলাদেশের ৬ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র৵সীমার মধ্যে বাস করে। তাদের অনেকেই উপায়হীন হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে আসে। তারা ভিক্ষাবৃত্তিকে একটি সহজ পেশা মনে করে।
আমরা জাতিতে একটু বেশি আবেগপ্রবণ। একজন শিশু যখন কারও কাছে ভিক্ষা চায়, তখন আমরা অনেকেই তাকে সহানুভূতি থেকে ভিক্ষা দিই। অনেক দরিদ্র মা-বাবা শিশুদের সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করে। কারণ, বড়দের থেকে মানুষ শিশুদের বেশি ভিক্ষা দেয়। এভাবে আমরা অনেকে হয়তো ভিক্ষাকে উৎসাহিত করছি। অনেকে শিশুদের ভাড়া করে এনেও ভিক্ষাবৃত্তির কাজ করায় বলে জানি। আবার যারা প্রতিবন্ধী, তারা পরিবার ও সমাজে অবহেলিত। তাদের জীবনধারণ অনেক কষ্টকর। অবশেষে তারা ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিতে বাধ্য হয়।
আমরা সুস্থ মানুষকে ভিক্ষা দিতে চাই না। কিন্তু প্রতিবন্ধী হলে আমরা ভিক্ষা দিই। এভাবেও ভিক্ষাকে উৎসাহিত করছি।
অনেক ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ও সংঘবদ্ধ চক্র কিছু মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তিতে পরিচালিত করে থাকে বলে আমরা জানি। ভিক্ষাবৃত্তির কারণ যা-ই হোক না কেন, এটা কোনোভাবেই একজন মানুষের পেশা হতে পারে না। মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে কোনোভাবেই আমরা এটা মেনে নিতে পরি না।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন কনভেনশনেও ভিক্ষাবৃত্তিকে কোনোভাবে সমর্থন করা হয়নি। আমাদের নিজস্ব এক অনানুষ্ঠানিক জরিপে দেখা গেছে, ২০০ জন ভিক্ষুক শিশুর মধ্যে ১৮৩ জনের বয়স ১০ বছরের নিচে। আমরা অবাক হয়েছি যে এত ছোট বয়স থেকে একজন শিশুকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে! এদের মধ্যে চারজন বলেছে, তারা ইচ্ছা করে ভিক্ষা করে। অন্যরা বলেছে, কেন ভিক্ষা করছে তারা তা জানে না। অর্থাৎ, কেউ না কেউ তাকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করছে। এরা প্রতিদিন ৫০ থেকে ২০০ টাকা করে পায়।
আমরা এসব শিশুকে সৃজনশীল ও দক্ষতামূলক শিক্ষার আওতায় এনেছি। এক বছরের একটা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার পর তাদের প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ করে দিই। এ জন্য তাদের মা-বাবাকে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আমাদের সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলর মা-বাবাকে বোঝান, ভিক্ষাবৃত্তি সম্মানজনক পেশা নয়। তাই মা–বাবাকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আওতায় এনেছি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র শিশু ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনে একটি অবস্থানপত্র তৈরি করে, যা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে প্রদান করা হয়। ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের জন্য কমিউনিটি দায়িত্ব নিতে পারে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করতে হবে। শিশু ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
নিশাত ফাতেমা রহমান
নিশাত ফাতেমা রহমান
পথশিশু যারা ভিক্ষা করে, অনেককেই লক্ষ করা যায়, তাদের কোনো নড়াচড়া নেই, শুধু শুয়ে আছে। জন্মের প্রথম তিন বছর শিশুদের বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়। আমার মনে হয়, তাদের ঘুমের বড়ি খাইয়ে বা অন্য কোনোভাবে অচেতন করে রাখা হয়। চারপাশের এত শব্দের মধ্যে তাদের ঘুমিয়ে থাকার কথা না। যে সময় তারা পরিবেশকে জানবে, সবকিছু দেখবে, শেখার চেষ্টা করবে, এই গুরুত্বপূর্ণ সময় তো তাদের ঘুমিয়ে কাটতে পারে না।
ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের রাস্তায় এ দৃশ্য দেখা যায়। এদের বয়স যখন পাঁচ–ছয় বছর হচ্ছে, তখন এরা যৌন বিষয়গুলো জেনে যাচ্ছে। খুব ছোটবেলা থেকেই এসব শিশু মাদকে আসক্ত হয়। অর্থাৎ, এদের জীবনের ধরনটাই বদলে যায়। প্রতিনিয়ত পথেঘাটে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এদের মানসিক–শরীরিক সব ধরনের বিকাশ প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে এদের তেমন কোনো বুদ্ধিবিবেচনার বোধ থাকে না। তারা জানে না অন্য মানুষের সঙ্গে তাদের আচরণ কী হবে, চলাফেরা কী হবে। এরা সমাজিকভাবে কারও সঙ্গে থাকতে পারে না। আচার–আচরণ, চলাফেরা করতে পারে না। ফলে বিভিন্ন মানুষ এদের মাদকসহ অনেক ধরনের খারাপ কাজে ব্যবহার করে। বস্তি এলাকার ২০ শতাংশ শিশু হারিয়ে যায়। এসব শিশু খুবই অরক্ষিত অবস্থায় চলাফেরা করে। ঘুম থেকে উঠেই এরা রাস্তায় চলে আসে।
এ শিশুগুলো আসলে কোথায় যায়? এরা কখনো চুরি হয়, বিক্রি হয় অথবা হারিয়ে যায়। আমরা একবার খোঁজাখুঁজি করে মহাখালীর একটা শিশুকে পেলাম মোহাম্মদপুরে। এসব ক্ষেত্রে মা-বাবা একেবারেই সচেতন না। এ জন্য আমরা বস্তি এলাকায় ৩০টি ডে কেয়ার সেন্টার করেছি।
দারিদ্র৵ এমনভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে যে তারা কোনো কিছু ঠিকভাবে করতে পারে না। মা-বাবাকে তাদের শিশুদের দেখে রাখার কথা বললে তারা বলে, ‘খাবার জোগাড় করব, নাকি শিশুদের দেখে রাখব?’ ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন করতে হলে এসব শিশুর মা–বাবাকে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
মাহবুবা নাসরীন
মাহবুবা নাসরীন
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপস্থাপনা থেকেই বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা গেছে। এ নিয়ে অনেক গবেষণা আছে। জাতিসংঘের একটা প্রতিবেদন করার জন্য পথশিশুসহ এদের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরাও এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। ঢাকা মহানগরের পথশিশুর ভিক্ষুক কত, এদের কোনো পরিসংখ্যান নেই।
এক হিসাব থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগরের ৪ লাখ ৫০ হাজার পথশিশু আছে। এদের মধ্যে ১০ শতাংশ সরাসরি যৌনকর্ম ও ৯ শতাংশ ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। ছেলেশিশুরা একটু বড় হলেই বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় চলে যায়। মেয়েশিশুদের বাল্যবিবাহ হয়। অনেকে বাসাবাড়িতে কাজ করে।
অধিকাংশ পথশিশুর অভিভাবক আছে। এ জন্য এদের কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্রে রাখতে গেলে অভিভাবক ও শিশুরা উভয়ই চিৎকার–কান্নাকাটি করে। পথশিশুদের ৭০ শতাংশের বেশি অভিভাবকদের সঙ্গে থাকে।
সত্যিকার অর্থে অভিভাবকদের স্বাবলম্বী করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে এ কাজ করছে না। কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতাকে এ ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর মনে করছি না। এখানে বিনিয়োগের প্রয়োজন। এটাকে একটা বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে।
আজ বিদেশিরা কিছু এলাকায় সভা করতে চায় না। কারণ, পথশিশুরা তাদের পোশাক ধরে টানাটানি করে। বিদেশিরা এটা বলেও থাকে। পথশিশুদের জন্য পর্যটনশিল্পের ওপরও প্রভাব পড়ে। অনেক সময় বিদেশিরা পর্যটনে নিরুৎসাহিত হয়। এটা বিদেশি বিনিয়োগের ওপরও প্রভাব ফেলে। যে দেশে শিশুশ্রম বেশি, সেখানে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে চায় না।
মানুষ কেন শহরে এসে উদ্বাস্তু হচ্ছে, সেটাও খুঁজে দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিল খুব কম। তারপর এগুলো প্রকল্পভিত্তিক। যেকোনো সময় প্রকল্প বন্ধ হতে পারে। তাই সত্যিকার বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিবারগুলোকে সমাজের মূলধারায় পুনর্বাসিত করতে হবে। এসব শিশুকে শিক্ষা, বিনোদন, খেলাধুলাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
ফারুক মঈনউদ্দীন
ফারুক মঈনউদ্দীন
২০১০ সালে কামরাঙ্গীরচরে একটি শিশুকে অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে আনা হয়েছিল। ভিক্ষাবৃত্তি রোধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না—২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এমন একটি নির্দেশ ছিল। চার বছর পরও এ বিষয়ে আর কিছু জানতে পারিনি। ৫৩৫টি প্রতিষ্ঠানে সিএসআর (কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা) বাজেট আছে। সিএসআরের মধ্যে অনেক ফাঁকি আছে। ব্যাংককে সবাই সিএসআরের সহজ উৎস মনে করে। কারণ, ব্যাংকের লাভ সবাই দেখতে পায়। আয়করের কাঠামোতে সত্যিকার অর্থে সিএসআরের ওপর আয়কর রেয়াত পাওয়া যায় না। আয়কর রেয়াতের সুবিধা পেলে ব্যাংকগুলো সিএসআরে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হবে। সিএসআর দিয়ে কেন ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন করতে হবে? ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের কাজটি করতে হবে বিনিয়োগের মাধ্যমে। এটি হবে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ। যেমন প্রথম আলো অদম্য মেধাবীদের সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এদের মধ্য থেকে একসময় অনেক বড় মানুষ, বড় নেতা বেরিয়ে আসবে। তাই কাজগুলোকে বিনিয়োগের আওতায় আনতে হবে।
আমরা যশোরসহ শিশুদের কয়েকটি পুনর্বাসনকেন্দ্রে সহযোগিতা দিয়ে থাকি। তবে সিএসআরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ব্র৵ান্ডিংয়ের বিষয়টি থাকে বলে সিএসআর কতটা কার্যকর হয়, সেটি নিয়ে হয়তো প্রশ্ন করা যেতে পারে। আমি মনে করি, কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে করতে পারলে নিশ্চয়ই একটি জনগোষ্ঠীর কল্যাণ হবে।
শাগুফা আনোয়ার
শাগুফা আনোয়ার
চলার পথে প্রতিনিয়ত আমরা ভিক্ষুক দেখি। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হই। কখনো গাড়ির জানালার কাচ টেনে দিতে হয়। আবার কিছু ভিক্ষুক দেখে মনে হয়, তারা এটাকে ইচ্ছে করে পেশা হিসেবে নিয়েছে। এদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া সম্ভব হবে না।
সমাজ থেকে যদি ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন করতে হয়, তাহলে তিন–চার বছরের একটি পরিকল্পনা করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে করলে এ ক্ষেত্রে সফলতা আসবে না। কাজটি পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। অনেক কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা আছে। সব সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে একটি সংগঠন করতে হবে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দিক থেকে কাজ করবে।
সমন্বিতভাবে কাজটি করতে হবে। যেমন আমি স্বাস্থ্যগত বিষয়টি দেখতে পারি। সিটি করপোরেশন এদের স্কুলে ভর্তির দায়িত্ব নিতে পারে। একজন দিবাসেবার বিষয়টি দেখতে পারে। সব ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। সিটি করপোরেশন ওয়ার্ডভিত্তিক ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের উদ্যোগ নিতে পারে। একটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব ওয়ার্ড কমিশনারসহ ওই ওয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি নিতে পারেন। তাঁরা শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য কাজ করবেন। এ ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করবে।
িসটি করপোরেশন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়—এ দুটি সংস্থা আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন করা কঠিন হবে না। আবার যারা সহযোগিতা করবে, তারাও যদি কিছুটা খোঁজখবর নেয় যে তাদের অর্থ কোনো ভালো কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তাহলে আরও কেউ যদি তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্র৵ান্ডিংয়ের জন্য সহযোগিতা করে, তাতে দোষের কিছু নেই।
পৃথিবীর কোনো মা–বাবা চাইতে পারেন না তাঁদের সন্তান ভিক্ষা করুক। অতএব, আমরা যদি ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত শিশুদের মা-বাবাকে ঠিকভাবে বোঝাতে পারি, তাহলে অবশ্যই তাঁরা সন্তানদের মানুষ করার জন্য এগিয়ে আসবেন। তবে এসব ক্ষেত্রে সবার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করা জরুরি।
আক্তার বাবু
আক্তার বাবু
ভিক্ষুকদের বিভিন্ন শ্রেণি বিভাগ রয়েছে। কিছু আছে পেশাদার ভিক্ষুক। আবার কিছু মৌসুমি ভিক্ষুক। আর সংঘবদ্ধ চক্র কিছু মানুষকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করে। জানার চেষ্টা করেছিলাম, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। অনেকে বলেছেন, এদের এতিমখানায় দেওয়া যেতে পারে। এখানে তাদের অন্ন–বস্ত্রের জন্য সহযোগিতা দেওয়া যেতে পারে। আসলে এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। এতিমখানা একটা নির্দিষ্ট সময় পর এদের বের করে দেয়। এদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা–দীক্ষা খুব একটা হয় না। সিএসআরের ক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এখানে ৫৩৫টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে, যারা সিএসআর করতে পারে। মনে করি, যে কেউ সিএসআর করতে পারে। এটা আরও বেশি ফলপ্রসূ সিএসআর হতে পারে—যেমন কেউ দুজন শিশু বা অন্তত একজন শিশুরও দায়িত্ব নিতে পারেন।
তিনি এসব শিশুর থাকা, খাওয়া, শিক্ষা, সবশেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। সমাজে এখন অগণিত বিত্তবান মানুষ আছেন। তাঁরা এভাবে দায়িত্ব নিতে পারেন। তাহলে প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন হবে।
যেকোনো পণ্য উৎপাদন কোম্পানি ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুদের কল্যাণে যুক্ত হতে পারে। যেমন তারা যেকোনো পণ্যের মূল্যের প্যাকেটে লিখে দিতে পারে যে এই মূল্যের একটা নির্দিষ্ট অংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। এভাবেও তারা সিএসআর হতে পারে। এ ব্যাপারে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।
টেলিকম কোম্পানিগুলোর বাজেট অনেক বিশাল। তারা ক্ষুদ্র একটা অংশ শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করলে শিশুদের সাফল্যজনকভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব নিয়ে হয়তো আমরা যেতে পারছি না। কোনো কল্যাণকর প্রস্তাব ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারলে অনেকেই সাড়া দেবে বলে মনে করি।
শাবনাজ জেহরীন
শাবনাজ জেহরীন
আমরা দেশের সব শিশুর সমান অধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব দিই। ১৮ বছর পর্যন্ত সবই শিশু। সবার অধিকার সমান। ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুদের জন্মনিবন্ধন নেই। এরা দেশের নাগরিক কি না, এটা বোঝা কষ্টকর হয়। দেশে আইন আছে, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে প্রত্যেক শিশুকে জন্মনিবন্ধন করাতে হবে।
এ ক্ষেত্রে মা-বাবা, নীতিনির্ধারক, প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের প্রত্যেক ওয়ার্ড কমিশনার গুরুত্ব দেবেন তাঁর ওয়ার্ডের শিশুদের জন্মনিবন্ধন হচ্ছে কি না। বাল্যবিবাহ, শিশু অপরাধ—এসব ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা শিশু জন্মের পর প্রথম অধিকার হচ্ছে তার জন্মনিবন্ধন। এ ক্ষেত্রে শহরের বস্তিগুলো ধরে এগোতে হবে। কারণ, বস্তির শিশুরা বেশি ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত। আমাদের এক অভ্যন্তরীণ জরিপে দেখেছি, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সের ছেলেশিশুরা বেশি ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত।
মা-বাবা মনে করেন, ভিক্ষাবৃত্তি আয়ের সবচেয়ে সহজ উপায়। এসব কারণে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুরা আসছে। পরিবারকে পুনর্বাসন করার কাজটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এ কাজ করছে।
মহিলা ও শিশু এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করি। প্রতি মাসে একটা শিশুকে—যে ভিক্ষাবৃত্তি ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত—সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনি। এদের মাসে দুই হাজার টাকা দিই, যাতে ভিক্ষাসহ যেকোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত থাকে। স্কুলে যায়। পরিবারের সঙ্গে থাকে।
ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিশুদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে সফল হয়েছে। আবার কে কীভাবে সিএসআর করছে, সে ক্ষেত্রে একটা তদারক সংস্থা থাকা দরকার, যাতে িসএসআরের অর্থ কল্যাণকর কাজে ব্যয় হয়।
হাসনা হেনা খান
হাসনা হেনা খান
ভিক্ষাবৃত্তি কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, এটা শিশু অধিকারেরও লঙ্ঘন। শিশুরা কেবল তাদের বেঁচে থাকার জন্যই ভিক্ষা করছে না, অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভিক্ষা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে মুনাফার জন্য শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের পঙ্গু করা হয়, যাতে তারা আরও বেশি আয় করতে পারে।
আমরা চাইলে এদের দক্ষ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করতে পারি। ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনে সুনির্দিষ্ট নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ দুটোর কোনোটিই এ ক্ষেত্রে নেই। কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের কাজ করছে। আজ আলোচনায় এসেছে, প্রতিদিন ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে আমাদের পদক্ষেপগুলো কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, সেটিও একটি প্রশ্ন। ভিক্ষাবৃত্তির সমস্যাটি বেশ গভীর। তাই এই সমস্যা নিরসনে কেবল সরকার নয়, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে একটি সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে।
বিচ্ছিন্নভাবে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে এর ফল তেমন সুদূরপ্রসারী হয় না। আজ আমাদের সঙ্গে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
আমরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুদের পুনর্বাসনের কথা হয়তো বেশি ভাবছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এদের পরিবারগুলোকে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও আয়মূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করা। তা না হলে এ সমস্যার সমাধান খুব একটা কার্যকর হবে না।
এম এম সুলতান মাহমুদ
এম এম সুলতান মাহমুদ
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৩০ লাখ বয়স্ক মানুষকে প্রতি মাসে ৪০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। বিধবা ও অসহায় ১৪ লাখ নারীকে ভাতা দেওয়া হয়। দেশে মোট ১৬ লাখ প্রতিবন্ধী আছে। ছয় লাখ প্রতিবন্ধীকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। ৬০ হাজার শিক্ষার্থীকে ভাতা দেওয়া হয়। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আমাদের আট কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।
হিজড়াদের প্রত্যেককে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য বরাদ্দ আছে ১৮ কোটি টাকা। প্রতি মাসে এদের ৪০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। চিকিৎসাসেবার জন্য বরাদ্দ আছে ২০ কোটি টাকা। আমরা অসহায় রোগীদের ৫০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা ভাতা দিই। চা–শ্রমিকদের ১০ কোটি টাকা ভাতা দিই।
ঢাকা শহরের ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য ময়মনসিংহে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হলো। কিন্তু তারা পালিয়ে আবার ঢাকায় আসে। এদের জন্য আমাদের বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। ইউনিসেফের সহায়তায় সাতটি বিভাগে আমরা কিছু কেন্দ্র করেছি। এখানে ভিক্ষুকদের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
৮৫টি সরকারি ও প্রায় চার হাজার বেসরকারি শিশু পরিবার আছে। সরকারি শিশু পরিবারের প্রতিটিকে দুই হাজার টাকা ও বেসরকারি শিশু পরিবারের প্রতিটিকে এক হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ভিক্ষুকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারেন। তাহলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আমাদের ভালো অভিজ্ঞতা নেই। ভাষানটেকে দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য ফ্ল৵াট বানিয়েছিলাম। যেসব লোক কাজের দায়িেত্ব িছলেন, তাঁরাই দরিদ্র সেজে এসব ফ্ল৵াট দখল করেছেন।
আমরা যাদের ভাতা দিই, তাদের নির্বাচন করেন স্থানীয় মেম্বার ও চেয়ারম্যান। এখানেও দুর্নীতি হয়। ভিক্ষুকদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের–আপনাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।
আনিসুল হক
আনিসুল হক
অনেক রকমের আলোচনা হয়েছে। কিন্তু করণীয় কী? কোনো কিছুর কোনো তথ্য নেই। ভিক্ষুকেরা এক জায়গায় থাকে না। এসব ক্ষেত্রে কে কাজটি করবে? কীভাবে করবে? অনেক প্রশ্ন এখানে আসতে পারে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ইউনিসেফ, ঢাকা সিটি করপোরেশন—এমন অনেক প্রতিষ্ঠানই হয়তো কাজ করছে। কিন্তু সমন্বিত কোনো উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে নেই।
১৯৯৪ সালে আমাদের পোশাকশিল্পে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমরা পোশাকশিল্পে শিশুশ্রম বন্ধ করেছিলাম। শিশুদের স্কুলিং ও অভিভাবকদের কাজের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। দুই বছরের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধ হয়েছিল। আজ এই ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত শিশুদের স্কুলিং এবং তাদের অভিভাবকদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
এখানে অনেক শিশুর নাম, ঠিকানা ও অভিভাবক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা একটা সমস্যা হতে পারে। উপস্থাপনায় দেখলাম কিছু পরিবারকে রান্নাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এখানে খরচ বেশি না। কিন্তু এটা টেকসই কোনো ব্যবস্থা কি না, সেটা বুঝতে হবে। যদি টেকসই ব্যবস্থা হয়, তাহলে এ উদ্যোগ নেওয়া কঠিন কোনো কাজ না।
কেউ যদি এ পরিবারগুলোকে এভাবে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেন, তাহলে আমরা তহবিলের ব্যবস্থা করতে পারব। অনেকে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বের কথা বলেছেন। আমাদেরও দায়িত্ব আছে, সেটা স্বীকার করতে হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের জনবল এত কম যে আমাদের পক্ষে এখন এ কাজ করা কঠিন। দুই হাজার জনবলের জায়গায় আছে মাত্র ১ হাজার ২০০ জন। কিন্তু কেউ যদি দায়িত্ব নেন, তাঁকে আমরা সহযোগিতা করতে পারি।
ছোট শিশুদের স্কুলের ব্যবস্থা করতে পারব। এফবিসিসিআইতে থাকার সময় প্রায় ১ হাজার ৬০০ পরিবারকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা করেছি। ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত সব শিশুর অভিভাবকদের উদ্যোক্তা করার ক্ষেত্রে কেউ যদি দায়িত্ব নেন, আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করব। সবাই আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আমার বিশ্বাস।
সুলতানা কামাল: আলোচনায় এসেছে, এটা মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের লঙ্ঘন। এটা একটা প্রচণ্ড অসম্মানজনক কাজ। আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। ভিক্ষাবৃত্তি শেষ করতে চাই। আইন ও সালিশ কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। আমরা বিশ্বাস করি বিন্দু থেকে সিন্ধু।
ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোয় শিশুদের মানসিক বিকাশের সুযোগ নেই। তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। অনেকটা জেলখানার মতো। তাহলে শিশুরা এখানে কেন থাকবে?
সিএসআরের টাকার ওপর আয়কর রেয়াতের বিষয়টি আবার তোলা যেতে পারে। আয়কর রেয়াতের সুবিধা পেলে সিএসআর বেশি হবে। ঢাকায় আমরা একবার গৃহকর্মীদের হিসাব বের করেছিলাম। এ ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কমিশনাররা ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন। এ অভিজ্ঞতা আমরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুদের বেলায়ও কাজে লাগাতে পারি।
শিশুরা যাতে পরিবারের মধ্যে থেকে বিকশিত হতে পারে, সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবারের বাইরে বা ভবঘুরে কেন্দ্রসহ অন্যান্য জায়গায় থাকলে শিশুদের সমাজের মূলধারায় আনার যে পরিকল্পনা, সে উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।
সরকার অনেক কিছু করছে। কিন্তু সঠিক তদারকসহ বিভিন্ন বিষয়ের অভাবে কাজগুলো কতটা টেকসই হচ্ছে সেটি একটি প্রশ্ন। শিশু অধিকার ফোরামের সঙ্গে সমন্বিতভাবে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের কাজটি করা যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যে কাজই করা হোক না কেন, সেটা টেকসই হবে কি না।
অনেকে বলেন, শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ। আমরা বলি, শিশুরা দেশের বর্তমান। তাদের বর্তমানকেই সুন্দর ও আলোকিত করতে হবে। তা না হলে এসব শিশুর সত্যিকার অর্থে কোেনা ভবিষ্যৎই থাকবে না।
আব্দুল কাইয়ুম: যত দ্রুত সম্ভব সমাজ থেকে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনে সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ কিছু সংগঠন কাজ করছে। তবে সবাই কাজটি সমন্বিতভাবে করলে ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের উদ্যোগ বেশি ফলপ্রসূ হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আরও গুরুত্ব দেবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
শিশুর ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন ও অভিভাবকদের পুনর্বাসন
ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন এবং ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশু ও তাদের অভিভাবকদের পুনর্বাসন করতে সরকার, সুশীল সমাজ ও করপোরেট খাতের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন
* শ্রমজীবী শিশুদের ৫৫ শতাংশ ঢাকায় বাস করে। এদের ৯ শতাংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত
* ভিক্ষা করছে এমন ২৩৯ জন শিশুর মধ্যে ১৮৩ জনের বয়স ১০ বছরের নিচে
* আইএলও কনভেনশন ১৯৯৯ অনুযায়ী শিশু ভিক্ষাবৃত্তি বাজে ধরনের শিশুশ্রম
সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র
আলোচনায় সুপারিশ
* সমাজ থেকে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে
* ভিক্ষাবৃত্তির কারণ যা–ই হোক না কেন, এটা কোনোভাবেই একজন মানুষের পেশা হতে পারে না
* ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনের জন্য কমিউনিটি দায়িত্ব নিতে পারে—এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে
* সিটি করপোরেশন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়—এ দুটি সংস্থা আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন করা কঠিন হবে না
* ভিক্ষাবৃত্তি নিরসনে সুনির্দিষ্ট নীতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন
যাঁরা অংশ নিলেন
আনিসুল হক : মেয়র, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
সুলতানা কামাল : নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
এম এম সুলতান মাহমুদ : যুগ্ম সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
মাহবুবা নাসরীন : সমাজবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নিশাত ফাতেমা রহমান : সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেেভলপমেন্ট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
ফারুক মঈনউদ্দীন : অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্যাংক
হাসনা হেনা খান : প্রোগ্রাম অফিসার, ইকো কো-অপারেশন
শাবনাজ জেহরীন : শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ
শাগুফা আনোয়ার : প্রধান, কমিউনিকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইউনাইটেড হাসপাতাল
আক্তার বাবু : পরিচালন প্রধান, সময় টেলিভিশন
গীতা চক্রবর্তী : সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.