আ.লীগের ভেতরে অস্থিরতা, মাঠে আতঙ্ক–উৎকণ্ঠা

দুই দিনের ব্যবধানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের তিন নেতা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সরকারি দলের সাংসদসহ কোনো কোনো নেতা প্রকাশ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থানও নিয়েছেন।
দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারের শক্ত অবস্থান কেউ কেউ সমর্থন করলেও অনেক নেতা আবার সমালোচনাও করছেন। তাঁরা বলছেন, বন্দুকযুদ্ধের নামে নেতা-কর্মীদের হত্যা করার মধ্যে কোনো সমাধান নেই। এঁদের কেউ কেউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফোন করে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দুর্বলতায় ফাঁকা মাঠ পেয়ে একশ্রেণির নেতা-কর্মীর খুনোখুনি, আধিপত্য বিস্তার ও অপরাধপ্রবণতায় ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে সরকারি দল। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। গত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দেন যে অপরাধী দলের হলেও ন্যূনতম কোনো সহানুভূতি দেখানো হবে না। অপরাধী যে-ই হোক, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
গত সোম ও মঙ্গলবার দুই দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছাত্রলীগের তিন নেতা নিহত হয়েছেন। সরকার এ পদক্ষেপের মাধ্যমে সারা দেশে দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভয়-শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও প্রবীণ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া ছাত্রসংগঠন। তাদের বিচ্যুতি আছে, থাকতেই পারে। তবে তার সমাধান ক্রসফায়ার নয়। রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। নেতা-কর্মীদের নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি করে সমাধানে পৌঁছাতে হবে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে রাজধানীর হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু মিয়ার নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, বন্দুকযুদ্ধ নয়, আরজুকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে র্যাব। বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা একটা তথাকথিত গৎবাঁধা কথা। এটার কোনো মানে হয় না। এটা বিশ্বাসযোগ্যও না।
এ ছাড়া হাজারীবাগের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আরজু মিয়ার নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ করা হয়েছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও এ ঘটনাকে র্যাবের বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করা হয়েছে। আরজু মিয়ার ক্রসফায়ার সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না। বিষয়গুলো তদন্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কেউ অপরাধে সম্পৃক্ত হলে ন্যূনতম ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমনকি সংগঠনের কারও বিরুদ্ধে অপরাধ নিশ্চিত হওয়া গেলে ক্রসফায়ারে দেওয়ার ব্যাপারেও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সবুজ সংকেত আছে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানকে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অপরাধে জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, ‘অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। খুব দ্রুত এ প্রবণতা কমে যাবে।’
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, মুষ্টিমেয় কিছু নেতা-কর্মীর অপকর্মের ভার দল নেবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের যেকোনো পদক্ষেপ দল সমর্থন করে। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। কমিটির কেউ কোনো অপরাধ করলে তাঁকে বহিষ্কার করে দিই।’
কয়েক দিন ধরেই সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একশ্রেণির নেতা-কর্মীর উদ্দেশে সতর্কতা ও হুঁশিয়ারিমূলক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের ‘খাই খাই’ স্বভাব ছাড়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সে রকম পরিবেশ যাতে আর সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তিনি নেতা-কর্মীদের অনুরোধ করেন। একইভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে বক্তব্য দেন।
জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের এ ধরনের সতর্কতার মধ্যেও বাড্ডায় ঝুট ব্যবসা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন নেতা হত্যা, জাতীয় শোক দিবসের দিন কুষ্টিয়ায় যুবলীগের এক নেতা হত্যা, চাঁদপুরের কচুয়ায় চাঁদার দাবিতে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রীদের ওপর যুবলীগের হামলা, হাজারীবাগে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে স্বীকার করেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যখন দৃশ্যমান থাকে না, তখন তা বিপজ্জনক। এ কারণেই এখন দলীয় নেতা-কর্মীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিছু নেতা-কর্মীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তবে তাঁরা এ কথাও বলছেন, কিছু নেতা-কর্মী নিজ স্বার্থেই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন। আগামী বছরের শুরুতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সম্ভাবনা থাকায় তাঁরা এলাকায় আধিপত্য সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তাই মারামারি হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতা ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এ বিষয়ে গত রাতে বিবিসিকে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকারের জিরো টলারেন্স, যে দলেরই হোক। কঠোরভাবে দমনই সরকারের উদ্দেশ্য। কোনো কিছুই ছাড় দেওয়া হবে না। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’ এ ক্ষেত্রে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটা প্রাণহানি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ তুলে সেখানকার স্থানীয় নেতারা নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.