ইস্কাটনে জোড়া খুন: সাংসদপুত্রের এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনায় অভিযোগপত্র চূড়ান্ত একমাত্র আসামি সাংসদপুত্র বখতিয়ার by নজরুল ইসলাম

বখতিয়ার আলম রনি
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে জোড়া খুনের মামলায় সাংসদপুত্র বখতিয়ার আলম রনিকে একমাত্র আসামি করে অভিযোগপত্র তৈরি করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আগামী সোম বা মঙ্গলবার আদালতে এই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হতে পারে। বখতিয়ারের মা পিনু খান সংরক্ষিত আসনের সাংসদ ও মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। অভিযোগপত্রে বখতিয়ারের ব্যবহার করা প্রাডো গাড়ির চালক ইমরান ফকিরসহ তিনজনকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই মামলায় সাক্ষী করা হচ্ছে। আদালতে দেওয়া ইমরানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকে সাক্ষীর জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণের জন্য আদালতে আবেদন করবেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) দীপক কুমার দাস। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ গত বুধবার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করার এবং বখতিয়ারকে একমাত্র আসামি করার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ইমরান ফকির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এতে তিনি জড়িত নন। তাই তাঁকে মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বখতিয়ারকে (৪২) তিন দফায় মোট ১১ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি। ডিবি সূত্র বলেছে, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি গুলি করার কথা জানালেও আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি হননি। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সূত্রবিহীন ও আলোচিত এই মামলার খুঁটিনাটি ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তিন মাসেরও কম সময়ে তদন্ত শেষ করা হয়েছে। সোম বা মঙ্গলবার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া গাড়িচালক ইমরান ফকির গত ১ মে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে (পৌনে দুইটা) বখতিয়ারকে বহন করা প্রাডো গাড়িটি নিউ ইস্কাটন রোডে যানজটে আটকে পড়ে। এতে চালকের পাশের আসনে বসা নেশাগ্রস্ত বখতিয়ার বিরক্ত হয়ে তাঁর লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে চার-পাঁচটি গুলি করেন। বখতিয়ারের বন্ধু আবাসন ব্যবসায়ী কামাল মাহমুদ ও মো. কামাল ওরফে টাইগার কামাল ঘটনার সময় গাড়িটির পেছনের আসনে বসা ছিলেন। তাঁরা আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, বখতিয়ার তাঁর পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছেন। এ ছাড়া ঘটনার আগে বখতিয়ারের সঙ্গে থাকা তাঁর আরেক বন্ধু জাহাঙ্গীর আলমও আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ব্যালাস্টিক প্রতিবেদন, প্রত্যক্ষদর্শীদের আদালতে জবানবন্দি, বস্তুগত প্রমাণ, তদন্ত ও অন্যান্য সূত্র থেকে ডিবি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, বখতিয়ারের এলোপাতাড়ি গুলিতে দৈনিক জনকণ্ঠ-এর সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী (৪০) ও রিকশাচালক আবদুল হাকিম (২৫) আহত হন। পরে তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
হাকিম মারা যান ১৫ এপ্রিল বিকেলে। সেদিন রাতে হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, গাড়ির জানালা খুলে একজন লোক এলোপাতাড়ি চার-পাঁচটি গুলি ছুড়েছে।
ইয়াকুব মারা যান ২৩ এপ্রিল রাতে। ইয়াকুবের বুকে গুলি বিদ্ধ হয় এবং হাকিমের পেছনের অংশে গুলি ঢুকে নাভির নিচ দিয়ে বেরিয়ে যায়। নির্মাণাধীন ভবন এলএমজি টাওয়ারের সামনে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, জোড়া খুনের এই মামলার তদন্তভার রমনা থানার পুলিশের কাছ থেকে ২৪ মে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে ন্যস্ত হয়। সূত্রবিহীন এ মামলা তদন্তের একপর্যায়ে ডিবি জনকণ্ঠ ভবনে স্থাপিত ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় ধারণ হওয়া ফুটেজে ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে ওই সড়কে দুবার কালো রঙের একটি প্রাডো গাড়ির (ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩-৬২৩৯) বেপরোয়া চলাচল দেখে। ডিবি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নথিপত্র দেখে নিশ্চিত হয়, ওই গাড়িটি সাংসদ পিনু খানের। একই সঙ্গে ডিবি তদন্ত, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা ও অন্য সূত্রের মাধ্যমে নিউ ইস্কাটনে ঘটনার আগে ও পরে বখতিয়ার ও ইমরানের অবস্থানও নিশ্চিত হয়। বখতিয়ার তাঁর মায়ের ওই গাড়িটি ব্যবহার করতেন।
পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা গাড়িচালক ইমরানকে শনাক্ত করেন এবং তাঁর অবস্থান নিশ্চিত হন। ডিবি ৩১ মে ইমরানকে আটক করে। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে ধানমন্ডির বাসা থেকে বখতিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দিনই বখতিয়ারের লাইসেন্স করা পিস্তলটি জব্দ করা হয়। ৪ জুন ডিবি ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য পিস্তলটি সিআইডির আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষা শাখায় পাঠায়। এই পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই পিস্তল থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে এবং নিহত ইয়াকুবের শরীরে পাওয়া গুলি ও ওই পিস্তলের গুলির ধরন এক, পয়েন্ট ৩২ বোরের। ১৪ জুন প্রাডো গাড়িটি জব্দ করা হয়। ৫ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে বখতিয়ারের পিস্তলের লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করেন।
সাংসদপুত্র বখতিয়ারকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে—এ কথা জানালে নিহত রিকশাচালক হাকিমের মা ও মামলার বাদী মনোয়ারা বেগম বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জানি ছেলে ফেরত পামু না, তবুও হত্যার বিচার হইলে মনে কিছুটা শান্তি পামু।’ তিনি বলেন, ‘বিচারের ভার আল্লাহর ওপর ছাইড়া দিছিলাম। এত দিন মনে করছিলাম গরিবের জন্য বিচার নাই, কিন্তু এহন দেখলাম গরিবের পাশেও মানুষ দাঁড়ায়।’ তিনি ডিবি পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

No comments

Powered by Blogger.