আপনজন ছাড়াই ঈদের আনন্দ by মানসুরা হোসাইন

শিশু পরিবারে ঈদ
মুখে সাদা প্রসাধন। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক। বেশ ঝলমলে থ্রিপিস পরা। এই সাজপোশাকে ঘুরছিল তাসলিমা। চোখেমুখে ঈদের আনন্দ। এ আনন্দ সে ভাগাভাগি করছে তার মতো আরও কিছু শিশুর সঙ্গে। ওরাই তার আপন। কারণ বাবা-মা বা অতি আপনজন বলতে ওদের কেউ নেই।
বাড়ি খবর জানতে চাইলে তাসলিমা একটু থমকে গেল। বলল, জানি না। বাবা-মা কোথায় থাকেন—এ প্রশ্নে চোখ দুটো ছলছল হয়ে গেল। বলল, ‘আমি তো ছোটবেলায় এইখানে আসছি। তাই কিছু জানি না।’
তাসলিমা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। তাকে খুব সুন্দর লাগছে—বলতেই ছলছল চোখে খুশির ঝিলিক দেখা গেল। তাসলিমা কুঁড়িয়ে পাওয়া শিশু। তার বাবা-মা আছেন কি না, কেউ জানে না। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোট মণি নিবাসে বড় হয়েছে ও। ছয় বছর বয়স থেকে আছে রাজধানীর সমাজসেবা অধিদপ্তরের তেজগাঁও সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা)। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত থাকতে পারবে। তারপর সরকারের পক্ষ থেকই বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে বা অন্য কোনো চাকরিতে ঢোকার সুযোগ করে দেওয়া হবে।
তাসলিমার মতো এ শিশু পরিবারের বেশ কয়েকজন আছে, যারা এসেছে ছোট মণি নিবাস থেকে। অন্যদের কারও হয়তো বাবা আছে, মা নেই। আবার কারও মা আছে, বাবা নেই। কয়েকজনের বাবা-মা দুজনই মারা গেছেন। শিশু পরিবারে এ ধরনের মেয়েশিশু আছে ১৬৩ জন। একজন ছুটিতে গেছে। পাঁচজন ছুটিতে গিয়ে এ পরিবারে আর ফিরে আসেনি।
আজ শনিবার ঈদের দিনদুপুরে শিশু পরিবারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আজ কারও মন খারাপ করার সুযোগ নেই। আজ এ পরিবারের শিশুদের অনেক ব্যস্ততা।
বয়সে ছোটরা গোলাপি চিকেন কাপড়ের ফ্রক পরেছে। সেই ফ্রকে নীল রঙের কাপড় দিয়ে ঝালর লাগানো। কারও কারও ফ্রকে নীল রঙের কাপড় দিয়ে পাইপিং করা। হাতে মেহেদির রং। চোখে কাজল, মাথায় বাহারি ক্লিপ, পায়ে জুতা। অনেকের হাতে মেহেদি লাগানো শেষ হয়নি। শিশু পরিবারের একটু বড় শিশুরা হাতে মেহেদি লাগাতে ব্যস্ত। বৃষ্টির কারণে ছোট শিশুদের আনন্দে একটু বাগড়া পড়েছে। শিশু পরিবারের যে ছোট পার্কটি রয়েছে, সেখানে গিয়ে তারা খেলতে পারছে না।
এ তো গেল ছোটদের কথা। বড়দের তো দম ফেলারও সময় নেই। শিশু পরিবারের চারটি হাউস। এসব হাউসে বড় লিডার (দলনেতা) ও ছোট লিডার আছে। তারা গতকাল শুক্রবার সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। আজ চার হাউসের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। কোন হাউসের মেয়েরা বেশি পদ রান্না করেছে, কোন হাউসের আলপনা অন্য হাউসের চেয়ে সুন্দর হয়েছে বা কোন হাউসের ঘর সাজানোসহ খাবারের সাজসজ্জা সবচেয়ে ভালো, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রতিযোগিতা শেষে শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষ পুরস্কার দেবে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের বড় কোনো স্যার এসব সাজসজ্জা দেখতে আসতে পারেন। তাই লিডাররা দুপুর পর্যন্ত গোসল বা সাজগোজ করে উঠতে পারেনি।
শিশু পরিবার সেজেছে শিশুদের তৈরি বিভিন্ন জিনিস দিয়ে। নিজেদের ওড়না, বেলুন, কাগজ কেটে বানানো ফুল, ছোট ছোট লাল-নীল বাল্বের মধ্যে গাছ লাগিয়ে বা খাবার টেবিলে বাটিতে পানি দিয়ে তাজা ফুল সাজিয়ে যে যেভাবে পেরেছে, নিজ নিজ হাউস সাজিয়েছে।
আজ দুপুরে হাউস শাপলা নিকেতনে ঢুকে দেখা গেল, বড় একটি টেবিলের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হরেক পদের খাবার সাজানো। এ হাউসের লিডার নাসিমা ও তাহমিনা খাবারের নাম বলে যেতে লাগল। টেবিলে আছে নুডুলস, চিংড়ি ভুনা, চটপটি, রুই মাছ, কুলি পিঠা, কেক, নকশি পিঠা, সেমাই, গোলাপ পিঠা, ডিমের কোর্মা, গাজরের সেমাই, চিড়ার বড়া, কাবাব, আলু ভর্তা এবং আস্ত ডিম দিয়ে বানানো হাঁস, পরোটা, ফালুদা, ফুলকপি ফ্রাই, পুডিং, রোল, তেলাপিয়া মাছ, হালিম, রোস্ট, নিমকি, কাস্টার্ড, স্যুপ, গরুর মাংস ভুনা, পোলাও ইত্যাদি।
তাহমিনা জানাল, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে একটি শরবত খেয়েছিল। সেখানকার লোকদের কাছে তা বানানোর পদ্ধতি জেনে এসেছিল। আজকে সুযোগ বুঝে সে শরবতও বানিয়েছে।
রজনীগন্ধা হাউস ৫০ পদের রান্না সাজিয়ে রেখেছে। এখানে রান্নার নতুনত্ব হিসেবে আছে ভারতের টিভি সিরিয়াল কিরণমালার নামকরণে কিরণমালা সেমাই। হাউস ডালিয়া নিকেতন করেছে ২৬ পদের রান্না। চম্পা নিকেতনও কম যায় না। আমড়ার চাটনি, খেজুরের চাটনি, গাজরের চাটনিসহ তারা করেছে ৪৪ পদের খাবার।
শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক ঝর্ণা জাহিন প্রথম আলোকে জানান, ঈদের আগে চারটি হাউসের লিডারদের নিয়ে সভা বসে। কোন হাউস কী রান্না করবে, তার চাহিদা চাওয়া হয়। সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ বাজার করে দেয়। পরিবারের পক্ষ থেকে ঈদের জামা-জুতা কেনার আগেও সভা হয়। কাপড় কিনতে যাওয়ার সময় শিশু পরিবারের কয়েকজন সদস্যও থাকে। সরকারের পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এবারের কাউন্সিলর বেল্লাল শাহ প্রতি বছর ঈদে শিশুদের এক সেট জামা, টিপ, চিরুনি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিস কিনে দেন।
ঝর্ণা জাহিন জানালেন, সরকারের পক্ষ থেকে ছোট বড় সব শিশুর জন্য খাওয়া, পোশাক, চিকিৎসা, লেখাপড়া, তেল, সাবানসহ অন্যান্য খরচের জন্য মাসিক বরাদ্দ দুই হাজার ৬০০ টাকা।
শিশু পরিবারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সরকারের অন্যান্য শিশু পরিবারের মতো এখানেও আছে জনবল সংকট। চারটি হাউসের জন্য আছে দুজন বাবুর্চি। তাই বাবুর্চিকে সাহায্য করার জন্য বড় মেয়েদের পালা করে থালাবাসন মাজতে হয়। শিশুদের স্কুল-কলেজে ভালো ফলাফল পেতে প্রাইভেট পড়া ও কোচিংয়ের তেমন কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন জনকে অনুরোধ করে প্রায় বিনা মূল্যে শিশুদের জন্য এসবের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
ঝর্ণা জাহিনকে সব শিশুরা আম্মা ডাকে। তিনি কোনো হাউসে ঢুকতেই ছোট শিশুরা ছুটে এসে আম্মা বলে জড়িয়ে ধরছে। কাল রোববার এই শিশুদের বাবা বা মা বা অন্য কোনো অভিভাবক নিতে আসবেন। পাঁচ দিনের ছুটি। তবে ছোট মণি নিবাস থেকে যারা এসেছে, তাদের নিতে কেউ আসবে না। তারা এখানেই ছুটি কাটাবে।
ঝর্ণা জাহিনের সঙ্গে এসব শিশুর সম্পর্ক বেশ নিবিড়। তাঁকে ছেড়ে ওরা বাড়ি যেতে চায় কি না—জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘আমার নিজের কোনো সন্তান নেই। ওরাই আমাকে আম্মা ডাকে। সব সময় আমাকে মাতিয়ে রাখে। এখানকার শিশুদের বেশির ভাগের বাবা নেই, মা আছে। যখন ওদের নিজের মা আসেন, তখন শিশুরা দৌড়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদের চেহারা দেখে মনে হয়, একেই বলে রক্তের বাঁধন! সন্তান জন্ম দেওয়ার সার্থকতা এখানেই।’

No comments

Powered by Blogger.