যেখানে ঈদের রং নীল by মানসুরা হোসাইন

ঈদে নতুন শাড়ি বা কোনো গিফট পেয়েছেন? প্রশ্ন শুনে মুখটি ম্লান হলো তাঁর। বললেন, ‘প্রায় এক মাস হলো, একটা প্যাকেট পাঠিয়েছে এক আত্মীয়। খুলে দেখিনি। আনন্দের খোলা তো নয়। গিফট খুলতে গেলেই তো শুধু ব্যথা আর ব্যথা।’
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে সারা দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। বিকেল বেলাতেও বৃষ্টির কমতি নেই। আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ প্রবীণহিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের নিবাস ভবনের বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে কথাগুলো বলেন মাসুমা সিদ্দিকী।
বৃষ্টির ঝাপটা এবং মাসুমা সিদ্দিকীর চোখের জল মিশে একাকার হয়ে গেল। তিন বছর ধরে তিনি এখানে আছেন। ঈদের দিন আর অন্য দিনের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। ঈদের দিন শুধু কষ্টের পরিমাণটা একটু বেড়ে যায়।
মাসুমা সিদ্দিকীর রুমে গিয়ে দেখা গেল ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক, চুল বব কাটের তাঁর আগের একটি ছবি। জানালেন, খুব সাজগোজ করতেন। শৌখিন ছিলেন। এখন তাঁর গায়ের ম্যাক্সি ও মাথার বড় স্কার্ফটি মলিন। নিজেই জানালেন, মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘অযথা খরচ বাড়িয়ে তো লাভ নেই।’ জানালেন, ঘরে নাতিদের ছবি টানানো ছিল। যেহেতু পরিচয় দিতে পারেন না, তাই ছবি নামিয়ে রেখেছেন।
পরিবেশ হালকা করতেই জানতে চাওয়া, পরিবারের সঙ্গে থাকতে ঈদের দিন কী কী করতেন? চোখেমুখে খুশির ঝিলিক মেখে বললেন, কাজের কী আর অন্ত ছিল। ছেলেমেয়েদের পছন্দের জামা কিনে ভাঁজ ভাঁজ করে রাখতে হতো। কে কী খাবে, কার কী পছন্দ তা দেখতে হতো।
ঈদ আসতে আর বেশি দেরি নেই। মাসুমা সিদ্দিকীর মুখের ঝিলিক মিলিয়ে গেল। স্বামী, মা, বোন মারা গেছেন। মেয়ে মারা গেছে এক বছরও হয়নি। মেয়ে যে এত অসুস্থ তা তাঁকে জানানো হয়নি। গিয়ে দেখেছেন মেয়ের লাশ। এ কষ্ট মেনে নিতে পারছেন না। এক ছেলে তাঁর পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন। ঈদের দিন পরিবারের কেউ তাঁকে দেখতে আসবে না। সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। তাই ঈদের দিন শরীর ভালো থাকবে কি না—তাই বা কে জানে। ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেউ ফোন করে না। গলায় ছোট ব্যাগে ঝুলিয়ে রাখা ফোনটি হাতে নিলেন মাসুমা। ফোনটি কখন থেকে যে বন্ধ হয়ে আছে তা নজরেই পড়েনি।
এক সময়ে সংসারের হাল ধরেছেন, এখন তাঁর আর নেই কোনো সংসার। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটির এ প্রবীণ নিবাসে বসবাসকারী ২৪ জন নারী ও ২২ জন পুরুষের আছে ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ইতিহাস। দীর্ঘশ্বাসের ধরনও আলাদা। মান–অভিমান বুকে চেপে তাঁরা এখানে কাটিয়ে দিচ্ছেন বছরের পর বছর। জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা অবস্থায় পরিবারের লোকজন দয়া করে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করেন। তারপর সেখান থেকেই অন্য জগতে পাড়ি দেওয়া।
এ নিবাসের বাসিন্দারা তাঁদের জীবনের কথা বলতে চান না। বিশেষ করে ঈদ নিয়ে কথা বলতে একেবারেই নারাজ। একজন বেশ খানিকটা খেপে গিয়েই বললেন, ‘এত ইতিহাস তো বলতে পারব না।’ একজন ঘরের মধ্যে বাতি নিভিয়ে বসে ছিলেন। তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পাওয়ার পর সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি কথা বলবেন না। নিবাসীদের ঈদ বলে কিছু নেই। এখানে ঈদের রং নীল। সেই নীল রঙে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করতে রাজি নন তাঁরা।
বিকেল গড়িয়ে বাইরে সন্ধ্যা নামছে। নিবাস ভবনের প্যাসেজে কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। সেখানে সোফায় দীর্ঘক্ষণ বসে ছিলেন একজন। কাছে গিয়ে কথা বলতে গেলে তিনিও খেপে গেলেন। বললেন, ‘পত্রিকায় লিখে হবেটা কী? লিখে দেন, জীবনের দায়ে এখানে আছি। উপায় নাই তাই আছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবীণ পুরুষ নিজের হাতে খিচুড়ি রেঁধেছেন। গন্ধে পুরো ঘর ভরে আছে। ঈদ প্রসঙ্গ আসতেই বললেন, ‘এ নিবাসের ঈদ তো নিরানন্দ। কোনো আনন্দ নেই। পাঞ্জাবি বেশ কয়েকটা জমে গেছে। তাই এবার আর নতুন পাঞ্জাবি কিনব না। ঈদের দিন দুইটা মিষ্টি মুখে দিয়ে নামাজ পড়তে যাব। তারপর দুপুরে নিবাসের কর্তৃপক্ষ একটু ভালোমন্দ খাবার দেবে, তা খাব। এই তো ঈদ শেষ। নয় বছর ধরে তো এভাবেই চলছে।’
প্রবীণ নিবাসের বারান্দায় বসে কয়েকজন। নিজেদের পড়ন্ত জীবনের কথাই হয়তো ভাবছেন। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
একসময় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন জানিয়ে এই প্রবীণ জানালেন, গত কোরবানির ঈদে দীর্ঘ আট বছর পর আধঘণ্টার জন্য ছেলে তাঁর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানেই আট বছর পর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়। অতিথিদের মতো তাঁরা স্বামী–স্ত্রী কুশলবিনিময় করেন। তারপর ছেলে আবার নিবাসে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
কথা প্রসঙ্গে ওই প্রবীণ জানালেন, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে এক ছেলে সবাই জীবিত। প্রচণ্ড অভিমানে বাড়ি ছেড়েছিলেন। অন্য সময় না হলেও ঈদের দিন সবাইকে কাছে পেতে মনটা কাঁদে। তাঁর ভাষায়—বেদনা বাড়িয়ে কী লাভ? ছেলে বাড়ি ফিরতে বলেছে। কিন্তু এখানেই তিনি বেশ আছেন। এ ছাড়া মনে ভয় জাগে—ছেলে, ছেলের বউ বা স্ত্রীর সঙ্গে যদি আবার ‘এডজাস্ট’ না হয়। কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে পেনশনের টাকা দিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনটা ভালোই কেটে যাচ্ছে।
মীরা চৌধুরী প্রবীণ নিবাসে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর স্বামী মারা গেছেন। এক ছেলে দেশের বাইরে থাকে। এলাকার মাস্তানদের উৎপাতে নিজের বাড়ি বিক্রি করে নিবাসে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। তাঁর রুমে স্বামী ও ছেলের ছবি। বান্ধবীর সঙ্গে ছবি টানানো। কালো শাড়িতে নিজের অনেক আগের একটি ছবি বাঁধাই করা। আরেকটি ছবিতে কলেজপড়ুয়া মীরা চৌধুরী। এখন ছবিই তাঁর সঙ্গী। একটি ছোট বিছানা। বিছানার সঙ্গে লাগানো একটি টুল। টেবিলে ছোট ছোট পানির বোতল। দেয়ালে ঝুলছে কয়েকটি ব্যাগ। আলনায় কাপড় রাখা। শেলফের ওপরে পলিথিনে মোড়ানো একটি পান্ডা। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছোট বারান্দায় টবে কিছু গাছ। বলতে গেলে এই হলো মীরা চৌধুরীর সংসারের সীমানা। নিবাসের অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছে তাঁর। নিবাসে দর্শনার্থীরা আসেন। সেই দর্শনার্থীদের মধ্যে কারও কারও সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে। স্কুল–কলেজের বান্ধবীরা নিয়মিত খোঁজ নেন। বেশি চা খান বলে এক বান্ধবী ইলেকট্রিক কেটলি কিনে পাঠিয়েছেন।
মীরা চৌধুরীর এখন ঘর ভাগাভাগি করার সংসার। ঘরের এক কোণে তিনি থাকেন। আরেক কোণে তাঁরই মতন আরেকজন। নিজের হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিচ্ছেন মীরা চৌধুরী। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মীরা চৌধুরী জানালেন, ঈদের দিন নিবাসের অন্যদের সঙ্গে ভালোমন্দ খাবার খাবেন। নিবাসে ঈদের দিন সেভাবে কেউ আনন্দ করেন না। নিবাসে ভালো থাকাটা বড্ড কঠিন হয়ে যায়। তবে ভালো লাগার পরিবেশটা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয় বলে জানালেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রবীণহিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আশরাফুল আলম কাজ করছেন ১৯৯৮ সাল থেকে। তিনি জানালেন, এখানে নিবাসীদের একক রুমের জন্য মাসে চার হাজার এবং ডাবল বা দুজনের রুমের জন্য ভাড়া দিতে হচ্ছে দুই হাজার টাকা। প্রবীণ ব্যক্তিরা নিজেরাই মেস সিস্টেম করে বাজার করে দেন। নিবাসের বাবুর্চি তা রান্না করেন। অনেকে খরচ কমানোর জন্য রুমে নিজেরাও রান্না করেন।
আশরাফুল আলম তাঁর টেবিলের কাচের নিচে একটি ছোট চিরকুট দেখালেন। ভালোবাসা দিবসে একজন নিবাসী কোনো আপনজনকে দিতে না পেরে আশরাফুল আলমকেই ইংরেজিতে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
নিবাসীদের একজন জানালেন, বিদেশে থাকা ছেলে খোঁজ নিচ্ছেন না। নিজের জমানো টাকাপয়সা কিছু নেই। নিবাসে ভাড়া দিতে না পারলে থাকতে দেবে না কর্তৃপক্ষ। আরও কয়েকজন নিজের জীবন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তবে নিজের ছেলেমেয়ের মানসম্মান যাতে নষ্ট না হয় তা নিয়ে ছিলেন সচেষ্ট। একজন মা বলে দিলেন, ‘আমার একটু সুবিধার জন্য ছেলেপুলের প্রেস্টিজ নষ্ট হোক তা তো চাইতে পারি না।’

No comments

Powered by Blogger.