রিমান্ডে মুহিতের লোমহর্ষক বর্ণনা by ওয়েছ খছরু

সৌদি প্রবাসী কামরুল বেধড়ক পিটিয়েছে রাজনকে। সকাল থেকেই কামরুল নির্যাতন চালাতে থাকে। বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে যায় মুহিত। এ সময় অন্যদের সঙ্গে সেও নির্যাতনে অংশ নেয়। একপর্যায়ে রাজন মারা গেলে লাশ গুমের চেষ্টা চালায়। রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য দিয়েছে মুহিত। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মুহিত ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। বলেছে, বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি রাজন মাটিতে পড়ে আছে। তখন শ্বাস নিচ্ছিল। তবে, কথা বলতে পারছিল না। ১০মিনিট পর দেখি কোন নড়াচড়া নেই। শরীরে হাত দিয়ে দেখি দেহ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’ সামিউল আলম রাজন খুনের সঙ্গে তারা ৫জন জড়িত ছিল বলে পুলিশের কাছে জানিয়েছে মুহিত আলম। সে ছাড়াও সেখানে তার সৌদি প্রবাসী ভাই কামরুল, আরেক ভাই ছাত্রলীগ নেতা আলী আহমদ, শামীম আহমদ ও পাহারাদার ময়না মিয়া ছিল। রিমান্ডে মুহিত জানিয়েছে, ‘সৌদি প্রবাসী ভাই কামরুল বেধড়কভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে রাজনকে। সকাল থেকে কামরুল রাজনের উপর অত্যাচার চালায়। মুহিত জানায়, ‘রাজন খুনের পর লাশ গুমের পরিকল্পনা করে। নিজেদের রক্ষা করতে লাশ গুম করার পরিকল্পনা করে। এ কারণে তারা মাইক্রোবাস নিয়ে আসে। এবং লাশ নিয়ে তারা টিলার কাছে যেতে চাইছিল। কিন্তু পথিমধ্যে স্থানীয় জনতা আটক করে।’ মুহিত পুলিশকে জানিয়েছে, সে এ ঘটনার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত নয়। তার ভাই কামরুল হচ্ছে রাজনের মূল ঘাতক। সিলেটের জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন গতকাল দুপুরে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, কামরুলকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয় সোমবার দুপুরে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কামরুল নিজেকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে কামরুলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগমকে আটক করে নিয়ে আসে। লিপিকে থানায় নিয়ে আসার পর মুহিত মুখ খুলতে শুরু করে। রাতে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদে মুহিত খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। তিনি বলেন, মুহিতকে থানা হাজতে রেখেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ওদিকে, গতকাল সকালে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে গ্রেপ্তারকৃত মুহিতের তালতো ভাই ইসমাইল হোসেন আবলুসকে সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম দ্বিতীয় ফারহানা ইয়াসমীনের আদালতে প্রেরণ করেন জালালাবাদ থানা পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে তার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালত থেকে বেরিয়ে এসে জালালাবাদ থানার ওসি তদন্ত আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন, সোমবার ভোরে গ্রেপ্তার করা হয় আবলুসকে। এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও পুলিশ ধারণা করছে সে ওই খুনের সঙ্গে জড়িত। ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে জানান তিনি। ওসি আক্তার জানান, পুলিশ কামরুলের অপেক্ষায় রয়েছে। সরকার কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। কামরুল দেশে এলে দুই ভাইকে মুখোমুখি করলে পুরো সত্য বেরিয়ে আসবে। পাশাপাশি শামীম, ময়না ও আলীকে গ্রেপ্তারে পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে। এদিকে গতকাল সকালে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. জয়নাল আবেদীন বাইয়ারপাড়স্থ রাজনের গ্রামের বাড়িতে যান। জেলা প্রশাসককে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার মা ও বাবা। তাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে সুরমার তীরবর্তী বাইয়ারপাড়ের পরিবেশ। জেলা প্রশাসক এ সময় কামরুলের পিতার কাছে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া ২০ হাজার টাকার অনুদান তুলে দেন। জেলা প্রশাসক এ সময় জানান, নির্মম এ ঘটনায় সান্ত্বনার কোনো ভাষা নেই। তবে, দোষীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে সরকার আন্তরিক রয়েছে।

মুহিতের বিচার চাইলেন লিপিও: মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগম। সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মুহিত আলমের স্ত্রী লিপি বেগমও বিচার চেয়েছেন নির্মম এই খুনের ঘটনার। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন খুনের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার স্বামী জড়িত থাকলে তারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন জানান, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে লিপি অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়।

এলাকাজুড়ে বিক্ষোভ: সিলেটের কুমারগাঁওয়ে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলার সব আসামির গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী। সোমবার রাতে টুকেরবাজারে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এদিকে, রাজনের সকল খুনিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ‘রাজন হত্যা বিচার বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ।’ সোমবার রাতে সিলেট সদর উপজেলার বাদেয়ালি গ্রামে রাজনের বাড়িতে সংগ্রাম পরিষদের এক সভা হয়। সভা থেকে বেলা ২টায় টুকেরবাজার তেমুখী এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ আহ্বান করা হয়। টুকেরবাজারে বিক্ষোভ মিছিলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বৃহত্তর টুকেরবাজার এলাকার বাসিন্দা কাজী জুনেদ আহমদ, মালেক মেম্বার, আব্দুল হাকিম, মোস্তাক আহমদ, অ্যাডভোকেট সৌরভ আরেফিন, গোলাম মোস্তফা জানু, আনছার মিয়া, জাহেদ, মাছুম, জুবায়ের, শাহেদ, আলতাফ মিয়া, শুভ প্রমুখ।

পুলিশের তদন্ত কমিটি: সিলেটে সামিউল আলম রাজন হত্যা তদন্তে সহায়তার জন্য সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) রহমত উল্যার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ। এডিসি রহমত উল্লাহ জানান, তিনি ছাড়াও কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার আফম নিজাম উদ্দিন, জালালাবাদ থানার এসি কামরুল ইসলাম, ওসি আখতার হোসেন ও সেকেন্ড অফিসার এসআই জাকির হোসেন। সোমবার রাতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নিজেই এ তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।

No comments

Powered by Blogger.