জাকাত, ২৭টি লাশ এবং নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ by সোহরাব হাসান

ময়মনসিংহের জর্দা কারখানায় জাকাতপ্রার্থীর ২৭টি লাশ
শুক্রবার ভোরবেলা। স্থান ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী সড়কের একটি বাড়ি। ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু ফটক। সেই ফটক খুলে দেওয়া হলো জাকাতপ্রার্থীদের জন্য। আর মেঘনার ভয়াল স্রোতের মতো মানুষ সেখানে ঢুকে পড়লেন। কিছুক্ষণ আগেও যাঁরা ছিলেন জীবন্ত মানুষ, মুহূর্তে তাঁরা হয়ে গেলেন লাশ। মানুষের পদতলে পিষ্ট হয়ে একটি-দুটি নয়, ২৭ জন নারী ও শিশু মুহূর্তে লাশ হয়ে গেলেন।
প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে অনেকগুলো নতুন-পুরোনো স্যান্ডেলের ছবি। বাড়ির আঙিনায় স্যান্ডেলগুলো পড়ে আছে। কিন্তু সেই স্যান্ডেল পরে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। তাঁরা এখন আর কেউ মানুষ নন, নিষ্প্রাণ নিস্তব্ধ মরদেহ। তাদের মধ্যে দুই বছরের শিশু যেমন আছে, তেমনি আছেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধা। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনায় একজন পুরুষও মারা যাননি। বাংলাদেশে যেকোনো প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের প্রথম ও প্রধান শিকার নারী ও শিশুরা। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাকাতপ্রার্থী পুরুষেরা সবাই পেছনে ছিলেন। নারীরা সামনে। ফলে পেছন থেকে আসা জনস্রোতের প্রচণ্ড ঢেউ গিয়ে পড়ে নারীদের ওপরই। দুর্বল, রুগ্‌ণ ও ক্ষীণ স্বাস্থ্যের নারী ও শিশুরা কীভাবে সামলে নেবেন সেই জনস্রোত? কারও হাত-পা-মাথা থেঁতলে গেছে। কারও পুরো শরীর রক্তাক্ত।
আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি। মানবতার সাচ্চা সেবক বলে বড়াই করি। অথচ প্রতিদিন আমাদের চারপাশে যেসব অমানবিক ও নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে চলছে, আমরা তার প্রতিকারের চেষ্টা করি না। কেবল মানুষই পদদলিত হচ্ছে না। পদদলিত হচ্ছে মানবতাও।
জাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। ধনীরা তাঁদের অর্জিত সম্পদের একটি অংশ গরিবকে দেবেন, সেটাই ইসলামের বিধান। কিন্তু এভাবে মাইকে ঘোষণা দিয়ে, কার্ড বিলি করে, মহা শোরগোল তুলে জাকাতের শাড়ি দেওয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে? কোরবানির সময়েও দেখি, দরিদ্র মানুষ ধনীদের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন এক টুকরো মাংসের জন্য। আর বাড়ির মালিকেরা কখনো তাঁদের হাতে এক টুকরো মাংস তুলে দেন, কখনো দূর দূর বলে তাড়িয়ে দেন। অথচ কোরবানির মূল কথাই হলো ত্যাগ।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ময়মনসিংহের জর্দা কারখানার মালিক শামীম তালুকদার প্রতিবছর জাকাতের শাড়ি বিলি করেন। এবারও জাকাতের শাড়ি বিলি করার জন্য কার্ড বিলি করেছেন। লোকমুখে শুনে সেই কার্ড পাওয়া লোকদের পাশাপাশি কার্ড না পাওয়া মানুষগুলোও ভিড় জমিয়েছেন। ছোট্ট গেট। অনেক মানুষ। কিন্তু তাঁদের সামাল দিতে কোনো ব্যবস্থা রাখেননি তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডাকার প্রয়োজনও বোধ করেননি। কোনো কোনো পত্রিকা লিখেছে, তাঁর বাসার দুই নিরাপত্তাকর্মী বিরাট জনস্রোতকে ঠেকাতে লাঠিপেটা করেছেন। তারপর একসময় লাঠিপেটা বন্ধ করেছেন এ কারণে যে তাতে আরও বেশি মানুষ মারা যেতে পারেন। গরিব মানুষের প্রতি কী নিষ্ঠুর আচরণ! মারা না যাওয়া পর্যন্ত লাঠিপেটাও জায়েজ!
এই নারীরা গিয়েছিলেন জাকাতের কাপড় নিতে। কিন্তু কাপড় না নিয়ে কাফনের কাপড় পরেই সেখান থেকে তাঁদের চলে আসতে হলো। বাংলাদেশে এখন সর্বত্র চলছে প্রদর্শনবাদিতা। ধনীরা তাঁদের ধনদৌলত জাহির করতে নানা কিছু করেন। এমনকি জাকাত দেন, তা-ও সবাইকে জানিয়ে। যদিও পবিত্র হাদিসে আছে, তুমি যখন ডান হাত দিয়ে কাউকে সাহায্য করবে, তখন খেয়াল রাখবে যেন বাঁ হাত জানতে না পারে।
এটিকে আমরা কী বলব? দুর্ঘটনা? হ্যাঁ, দুর্ঘটনা। তবে সেটি মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা। আমাদের অসমতল সমাজ সৃষ্ট দুর্ঘটনা। বিকট বৈষম্যময় অর্থনীতি সৃষ্ট দুর্ঘটনা। আমরা এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছি, যেখানে প্রতিনিয়ত মানবতা লাঞ্ছিত হয়। বেঘোরে নিরীহ ও গরিব মানুষ প্রাণ হারায়। আমরা সম্পদের জৌলুশ দেখাতে ভালোবাসি, কিন্তু মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে চাই না।
তবে একটি সান্ত্বনা নিয়ে হয়তো জাকাতের কাপড়প্রার্থী ওই ২৭ জন নারী ও শিশু মারা গেছেন। বেঁচে থাকতে তাঁরা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে কিছু না পেলেও মৃত্যুর পর অন্তত ১০ হাজার কিংবা ২০ হাজার করে টাকা পেয়েছেন। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে আমরা যে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি।

No comments

Powered by Blogger.