এক দশক ধরে শুধুই সিদ্ধান্ত, প্রয়োগ নেই by আনোয়ার হোসেন

সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সিদ্ধান্তের কথা বলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগ ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ইজিবাইকের মতো ধীরগতির যান চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা বলা হচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। এ ক্ষেত্রে গত দুই বছরে দেওয়া বিশেষজ্ঞ পরামর্শ এবং একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
সর্বশেষ গত বুধবার এক সভায় মহাসড়কে অটোরিকশাসহ ছোট যান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু গত বৃহস্পতিবারও সড়ক ও মহাসড়কে এসব ছোট যান নির্বিঘ্নে চলেছে। ২০০৬ সালে সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিলের বৈঠকে এসব ধীরগতির যানবাহন সড়ক থেকে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ২০১২ সালে একই বৈঠকে তা সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর প্রতিটি বৈঠকেই এই সিদ্ধান্ত আলোচিত হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের ঘোষণা এসেছে।
সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় এখন সড়ক-মহাসড়ক অধিকতর প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ। দুর্ঘটনা ঘটে প্রায় ছয় হাজার। অবশ্য সরকারি হিসাবে দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা দুই হাজারের সামান্য বেশি। প্রতিবছরই তা কমছে।
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ কমিটি হচ্ছে সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিল। এর প্রধান হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। আর বিভিন্ন উৎসবকেন্দ্রিক সড়ক নিরাপত্তায় ডাকা হয় আন্তমন্ত্রণালয় সভা। সেখানেও সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী। গত দুই বছরে এই দুই কমিটির বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নেওয়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি।
গত বছর ঈদুল আজহার আগে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মহাসড়ক, রেল ও নৌপথে বড় দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনে হেলিকপ্টারের সহায়তা নেওয়া হবে। এরপর এ নিয়ে আর কোনো আলোচনাই হয়নি। এবারের ঈদুল ফিতরের বৈঠকেও হেলিকপ্টারের বিষয়টি সিদ্ধান্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এভাবে যেখানেই বড় দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানেই সড়ক চার লেন করার ঘোষণা দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জনচাপে এভাবে নেওয়া তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের বেশির ভাগই পরে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। তবে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আদলে সারা দেশে প্রায় দেড় শ দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানে (ব্ল্যাক স্পট) সড়ক বিভাজক বসানো এবং বাঁক সোজা করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে সরকারের বক্তব্য জানতে গতকাল রাতে বারবার ফোন করা হলেও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে পাওয়া যায়নি।
পরে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ধীরগতির যানবাহন বন্ধে ১ আগস্ট থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে সচিব বলেন, অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সবার সমন্বয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী মাসে শুধু ওই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে একটা বৈঠক হবে। সহজ শর্তে পেশাদার চালকের লাইসেন্স নবায়নের বিষয়ে সচিব বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করে যদি মনে হয় সিদ্ধান্তের অপব্যবহার হচ্ছে, তাহলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না: ২০১১ সালে সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিল সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সুপারিশ তৈরির জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে নয় সদস্যের কমিটিতে বুয়েটের শিক্ষক, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও মালিক-শ্রমিক নেতারা ছিলেন।
২০১২ সালের মাঝামাঝি কমিটির সদস্যরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে প্রায় ৭৮টি সুপারিশ করেন। এর মধ্যে ৫২টিই স্বল্পমেয়াদি। কিন্তু এর বেশির ভাগই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
কমিটির স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ছিল, দুর্ঘটনার জন্য দোষী ব্যক্তি চালক-মালিক-প্রকৌশলী-ফিটনেস অথরিটিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এই সুপারিশ দেওয়ার পর নাটোরের বড়াইগ্রামে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৬ জন মারা যান। পরে তদন্ত কমিটি জানতে পারে, দুর্ঘটনায় পড়া দুটি বাসেরই চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট ও ফিটনেস) সনদ ছিল না। কমিটি বাস ও ট্রাকচালক এবং দুই বাসের মালিককে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয়। এ ছাড়া দুর্ঘটনার পর হানিফ পরিবহনের একটি বাস হতাহত ব্যক্তিদের মাড়িয়ে যায় বলে তদন্ত কমিটি জানতে পারে এবং দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলেও আর কিছুই হয়নি। গত বছর ঢাকার কারওয়ান বাজারে সাংবাদিক জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরীকে একটি মিনিবাস চাপা দিলে তিনি মারা যান। এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা শোনা যায়নি।
আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিটি স্বল্পমেয়াদি আরও যেসব সুপারিশ করে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মহাসড়কে অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ইজিবাইক চলাচল বন্ধ করা। দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই করে যথাযথ আইন মেনে লাইসেন্স দেওয়া। পরিবহনচালকদের নিয়োগপত্র প্রদান বাধ্যতামূলক করা। সড়কে যথাযথ সংকেত স্থাপন করা।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মহাসড়কে হাটবাজার স্থাপন নিষিদ্ধ করা, পর্যায়ক্রমে সব সড়ক-মহাসড়কে সড়ক বিভাজক দেওয়া, সড়ক দুর্ঘটনার একটি মামলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালনা করে এর রায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
এসব মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
দুর্ঘটনার হিসাবও রাখতে পারছে না সরকার: ২০১২ সালের সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিলের এক সভায় সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও পুলিশের মাধ্যমে যুগপৎভাবে তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।
পুলিশ সূত্র জানায়, দুর্ঘটনার পর ৬৮টি ঘর পূরণ করে তথ্য সংরক্ষণ করতে হয়। এতে পুলিশ খুব একটা আগ্রহ পায় না। জেলা প্রশাসনেরও প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। ফলে সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়ন হয় না। এতে সরকারি হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি হিসাবের বড় ধরনের গরমিল হচ্ছে।
জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দুর্ঘটনার সংখ্যা ও হতাহতের যে সংখ্যা তাঁরা পেয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি। দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পনা করতে হলে তো সঠিক তথ্য প্রয়োজন। সরকারি তথ্যই যদি ভুল হয়, তাহলে পরিকল্পনা তো সঠিক হবে না।
মোটরযান আইন: সরকার মোটরযান আইন হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেয় ২০১০ সালে। ২০১২ সালে একটি খসড়াও প্রস্তুত করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা আইনে পরিণত করতে পারেনি সরকার।
আইনের খসড়া তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, খসড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ী চালকের বিরুদ্ধে শাস্তি বৃদ্ধি এবং দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তের পক্ষে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ জন্যই মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এরপর আর তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, মোটরযান আইনটি যুগোপযোগী করা খুবই জরুরি। দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির ধারায় এই অপরাধকে জামিন-অযোগ্য করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁরা। এরপর আর বিষয়টি এগোয়নি।
পেশাদার চালকের লাইসেন্সে ছাড়: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার পেশাদার চালককে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স দিয়েছে বিআরটিএ। ২০১১ সালে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর হাইকোর্ট এভাবে লাইসেন্স দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। গত চার বছর সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিলের প্রতিটি বৈঠকে পেশাদার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) উল্টো যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স পাওয়া চালকদের সহজ শর্তে নবায়নের সুযোগ দিয়েছে। মোটরযান আইন অনুযায়ী, পেশাদার চালকের লাইসেন্স নবায়ন করতে হলে সারা দেশে থাকা ড্রাইভিং কম্পিট্যান্সি বোর্ডের মাধ্যমে শারীরিক ও লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু বিআরটিএ গত ফেব্রুয়ারিতে বোর্ডের মাধ্যমে পরীক্ষার বদলে বিআরটিএর একজন মোটরযান পরিদর্শকের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অধিক জনসংখ্যার দেশে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন করা দরকার। নইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মহাসড়ক থেকে ছোট যান উচ্ছেদও এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে, তাই সুপারিশ আসা মাত্রই তা বাস্তবায়ন করা উত্তম।

No comments

Powered by Blogger.