আবাসিক হোটেলে খুন- কিনারা করতে পারে নি পুলিশ by রুদ্র মিজান

রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলো থেকে প্রায়ই লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু রহস্যময় এসব মৃত্যুর কোন কূলকিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হোটেল কর্তৃপক্ষের অনিয়মের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নিহতের সঠিক নাম-ঠিকানা পর্যন্ত উদ্ঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না। বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয় লাশ। এসব রহস্যময় মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। নারীদের ক্ষেত্রে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা আর পুরুষের ক্ষেত্রে মানব পাচার ও মাদক ব্যবসা নিয়ে নানা রকম দ্বন্দ্বের কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে।
সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে রয়েছে তিন শতাধিক আবাসিক হোটেল। অনেক হোটেলই কক্ষ ভাড়া দেয়ার বদলে মাদকসহ অবৈধ নানা রকম বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। সন্ত্রাসী, মাদকসেবী, মানব পাচারকারীদের আস্তানা যেন এসব হোটেল। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায়ই ঘটছে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা। গত নয় বছরে আবাসিক হোটেলগুলো থেকে দেড় শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক লাশেরই কোন পরিচয় উদ্ঘাটন করতে পারে নি পুলিশ। হোটেল কর্তৃপক্ষের খাতায় যে ঠিকানা দেয়া হয় তা সঠিক থাকে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলেই দুর্বৃত্তরা প্রকৃত নাম-ঠিকানা গোপন করে। নিয়ম অনুসারে হোটেল বোর্ডারদের নাম-ঠিকানাসহ বিভিন্ন তথ্যসংবলিত ফরম পূরণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি প্রদান ও আলোকচিত্র ধারণের নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ হোটেলগুলোই এসব নিয়ম মেনে বোর্ডারদের কক্ষ ভাড়া দেয় না। ২০১০ সালের ১৬ই আগস্ট গুলশানের নিউ এয়ারপোর্ট রোডের হোটেল লর্ডস ইন থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তরুণীকে হত্যা করার অভিযোগে হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর নুরুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে পুলিশ, পরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করলেও এ ঘটনার কোন ক্লু উদ্ধার করতে পারে নি। এমনকি ওই তরুণীর সঠিক নাম-ঠিকানাও পাওয়া যায়নি। সূত্রে জানা গেছে, হোটেলের বোর্ডার খাতায় ওই তরুণীর নাম লেখা ছিল সীমা আক্তার। তার সঙ্গী যুবকটির নাম রফিকুল ইসলাম। তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ওই হোটেলের ৫০৩ নম্বর কক্ষে উঠেছিল। ঠিকানা হিসেবে নরসিংদী উল্লেখ করা হলেও সূত্রে জানা গেছে, রফিকুল ইসলামের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর থানার ঘিলারচালা গ্রামে। সূত্র মতে, নারী পাচারকারী চক্রের একজন হচ্ছে এই রফিকুল ইসলাম। প্রেমের অভিনয়, বিয়ে, চাকরিসহ নানা প্রলোভন দিয়ে কিশোরী, তরুণীদের ঢাকায় এনে দেশের বাইরে পাচার করা ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করাই হচ্ছে এ চক্রের কাজ। সীমা পরিচয় দেয়া ওই তরুণীকে সেভাবেই ঢাকায় আনা হয়েছিল। হোটেল লর্ডস ইনে তোলার পর তাকে ধর্ষণ করে রফিকুল। পরে কয়েক দালাল ও খদ্দের তাকে ধর্ষণ করে। ওই তরুণীকে পতিতা ব্যবসায় বাধ্য করানোর জন্য নানাভাবে নির্যাতন করা হয় বলে হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে। উপর্যুপরি নির্যাতনের কারণে মধ্যরাতে জ্ঞান হারায় ওই তরুণী। ভোরে তাকে ওই কক্ষে ফেলে দালাল ও খদ্দেররা পালিয়ে যায়। পরে তরুণীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় হোটেলের কর্মচারী আবু তাহের ও শহীদ। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন তাকে। এ সময় শহীদ ও তাহের পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের আটক করে পুলিশ। ঘটনা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নেই। এ ঘটনা থেকে হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য আরও নাটকীয় ঘটনা ঘটানো হয়। ঢামেক হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ নিয়ে যায় বাগেরহাটের চিতলমারী থানা সদরের লাভলু নামের এক ব্যক্তি। সে ওই তরুণীকে নিজের স্ত্রী পরিচয় দেয়। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে তিন দিন পর রহস্যজনকভাবে লাশটি আবার গুলশান থানায় দিয়ে যায় লাভলু। কিন্তু রহস্যজনকভাবে এ ঘটনায় কাউকেই আটক করেনি পুলিশ। ওই মামলার বাদী নুরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, প্রতিটি তারিখেই আদালতে উপস্থিত ছিলেন তিনি। কিন্তু গত মে মাসে একটি তারিখে হাজির না হলে মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত। তার আগে তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে মামলার কোন ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেন নি তিনি। এমনকি নিহতের সঠিক নাম-ঠিকানাও পাওয়া যায়নি।
একইভাবে ২০১২ সালে রামপুরার হোটেল মিরাজ থেকে সুমির নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায়ও আদালতে মামলা করা হয়। মামলা করার পর সুমির নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। সূত্র মতে, একই উদ্দেশ্যে তাকে ওই হোটেলে নিয়ে তোলে দুর্বৃত্তরা। পতিতাবৃত্তিতে রাজি না হলে গণধর্ষণ করা হয় তাকে। প্রতিবাদ করলে একপর্যায়ে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গত বছরের ৯ই নভেম্বর বড় মগবাজারের গ্রিন টাওয়ার আবাসিক হোটেল থেকে আসাদুজ্জামান নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরে শাহবাগের উত্তরবঙ্গ আবাসিক হোটেলের ২১১ নম্বর কক্ষ থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার আগে ২০১৩ সালের ২৫শে নভেম্বর মহাখালীর আল-মদিনা হোটেল থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার নাম মো. হেলাল উদ্দিন। একই বছরে দক্ষিণখান থানার হোটেল ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১২ সালে মহাখালীর যমুনা হোটেল থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বছরে হোটেল মতিঝিল থেকে এক তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার আগের বছর শিল্পাঞ্চল থানার হোটেল মহাখালী থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১০ সালে ফকিরাপুলের হোটেল রাকীবের চতুর্থ তলার একটি কক্ষ থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০০৯ সালে ফকিরাপুলের হোটেল জোনাকী (বর্তমানে আল-আকসা) থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার আগের বছর ওই এলাকার হোটেল আতিক থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বছরে আরামবাগের হোটেল আল-ফয়সলের দ্বিতীয় তলার কক্ষ থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০০৭ সালে নবাবপুরের মর্ডান আবাসিক হোটেল থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০০৬ সালে ফকিরাপুলের হোটেল আল-হেলাল থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বছর মতিঝিলের কাজী জসিম উদ্দিন রোডের হোটেল টাওয়ারের পঞ্চম তলা থেকে এক তরুণীর বিবস্ত্র লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশটি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল।
এ বিষয়ে হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আলমগীর সেলিম জানান, হত্যাকাণ্ডগুলো নানা কারণে ঘটে। একটি অংশ নিজেদের শারীরিক চাহিদার জন্য ভুল তথ্য দিয়ে হোটেলের কক্ষ ভাড়া করে। এ ক্ষেত্রেও তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বোর্ডার পরিচিত হওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষ কোন তথ্যই লিপিবদ্ধ করে না। পরে যে কোন বিষয় নিয়ে নারী-পুরুষের দ্বন্দ্বের জের ধরে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটে। দুষ্কৃতকারীদের আরেক অংশ মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করে, বিয়ে, চাকরি ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে হোটেলে নিয়ে যায় তরুণীদের। পরে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার জন্য নির্যাতন করা হয়। গণধর্ষণ, মারধর কোন নির্যাতন থেকেই রেহাই দেয় না দুর্বৃত্তরা। এসব কারণেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া অর্থ লুটসহ শত্রুতার জের ধরেও ঘটে হত্যাকাণ্ড। এসব হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে হত্যার পর লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এজন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের অসাধু কর্মকর্তাদের দায়ী করেন আলমগীর সেলিম। তিনি জানান, নানা তথ্যসংবলিত ফরম পূরণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি গ্রহণ ও আলোকচিত্র ধারণের নিয়ম থাকলেও হোটেলগুলো তা না মেনেই বোর্ডারদের কক্ষ ভাড়া দিয়ে থাকে। যে কারণে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও সঠিক তথ্যের অভাবে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না।
হোটেলগুলো থেকে গত কয়েক বছরে কতগুলো লাশ উদ্ধার করা হয়েছে আলাদাভাবে এর কোন হিসাব পাওয়া যায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, অতীতে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও সঠিক তথ্যের অভাবে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে এখন কড়া নজরদারিতে রয়েছে হোটেলগুলো। আইন ভঙ্গ করলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.