মানব পাচার- নৌপথে মর্মন্তুদ অভিবাসন ও দাসপ্রথা by জহির আহমেদ

অজানা গন্তব্যের খোঁজে সাগরে ভাসছে মানুষ
২০১৫ সালের শুরুতে ১০১তম বিশ্ব অভিবাসন দিবস উপলক্ষে ভ্যাটিকানের পোপের বাণীটি তাৎপর্যপূর্ণ। বাইবেলকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন যে, ‘আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে খাবার দিয়েছিলে; আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে সুপেয় পানীয় দিয়েছিলে; আমি আগন্তুক ছিলাম, তুমি আমাকে স্বাগত জানিয়েছিলে; আমি নগ্ন ছিলাম, তুমি আমাকে বস্ত্র পরিধান করিয়েছিলে; আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, তখন তুমি আমাকে দেখতে এসেছিলে; আবার আমি যখন কারাগারে ছিলাম, তুমি তখনো আমার কাছে এসেছিলে।’ অভিবাসী ও শরণার্থীকে ভালোবাসা খ্রিষ্টধর্মের প্রাণভোমরা। কারণ, যিশুখ্রিষ্টের বাণী সর্বপ্রথম পৌঁছেছিল বেথলেহেমের গরিব আর উদ্বাস্তু মানুষের কাছে। এই বাণীর একপর্যায়ে পোপ বলেছেন যে, বর্তমান যুগ অভিবাসনের যুগ, বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে যাচ্ছে, ভয় আর আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর তাদের স্যুটকেসগুলো। একটি অনিশ্চিত ও বিপৎসংকুল অথচ আশাবাদী মানুষগুলো জীবনধারণের খোঁজে ঘর থেকে বের হয়েছে। কিন্তু তাতে কী?
বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যাংকক, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জীবিকার সন্ধানে যে বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে এবং গহিন অরণ্যে তাদের গণকবরের যে নিরন্তর সন্ধান মিলছে, তা আমাদের হতবিহ্বল করে, অভিসম্পাত দেয়। আফ্রিকার দাসদের করুণ মৃত্যুর যে বয়ান ইতিহাসের কাছ থেকে আমরা পাই, বাংলাদেশের অভিবাসীদের সাম্প্রতিক ঘটনা সে কথা আর একবার মনে করিয়ে দেয়।
২০০৬ সালে আফ্রিকার অভিবাসন-সংক্রান্ত গবেষণায় অংশ নিতে আমি ঘানায় তিন সপ্তাহের জন্য যাই। অন্য সতীর্থদের সঙ্গে আমিও আলমিনা ক্যাসেলে যাই। এটা হচ্ছে আফ্রিকার সবচেয়ে পুরোনো এবং বৃহদাকার দাসের কেন্দ্র। গাইডের বয়ান, খোদাই করা লিখিত বার্তা আর মনোজগতে আফ্রিকার উপনিবেশবাদের যে প্রবল বঞ্চনার কথা আমি পরিচিত ছিলাম, তার চাক্ষুষ প্রমাণ আমাকে মানুষ হিসেবে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। এই ক্যাসলটি বর্তমানে একটা জাদুঘর। গাইডের বয়ানে আলমিনার স্থানীয় ইতিহাস এবং দুই শ বছরের ট্রান্স-আটলান্টিক দাস ব্যবসার যে মর্মন্তুদ ইতিহাস ছিল, সেটি কিঞ্চিৎ হলেও অনুধাবন করা যায়।
ক্যাসলের ভেতরে শুরুতেই কতগুলো সেল/প্রকোষ্ঠ পাশাপাশি অবস্থিত। প্রথম সেলগুলোতে সাদা চামড়ার সৈনিকের কথা লেখা রয়েছে। তারা যদি নারী দাসদের ধর্ষণ করত, তাহলে শাস্তিস্বরূপ তাদের কিছু সময়ের জন্য এই সেলগুলোতে রাখা হতো। পরের সেলগুলোতে স্থান হতো বিদ্রোহী দাসদের, যাদের মৃত্যু পরোয়ানার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। কিছু সেলে নারী দাসদের শিকল পরিয়ে উপুড় করে রাখা হতো। তাদের রক্তস্রাব, মূত্র ও মলের মধ্যেই থাকতে হতো। এই সেলগুলোর পরেই একটা বারান্দা রয়েছে, যেখানে কমান্ডিং অফিসার দাঁড়িয়ে থাকত। তির্যক দৃষ্টি রাখত কোন নারী দাসকে সে শয্যাসঙ্গিনী করবে, কাকে ধর্ষণ করবে, তা এখান থেকে সে সিদ্ধান্ত নিত। এই সাদা চামড়ার অফিসাররা প্রথমে ছিল পর্তুগিজ এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ।
এরপর দোতলায় রয়েছে অনেকগুলো কক্ষ, যেখানে কমান্ডিং অফিসার বিশাল একটি রুমে থাকত। রয়েছে দুটি রান্নাঘর। গাইড জানিয়েছে যে বিজিত পর্তুগিজদের রান্নাঘর বিজয়ী ইংরেজরা ব্যবহার করতে চায়নি। এ কারণে যে পর্তুগিজরা হয়তো শত্রুতাবশে রান্নাঘরে বিষ রেখে যেতে পারে এবং তাদের মৃত্যু হতে পারে। দোতলার পশ্চিম প্রান্তের ঠিক নিচতলায়, যেখানে বিদ্রোহী দাসদের পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয়। যে সেলটির সামনে লেখা আছে ‘ডোর অব নো রিটার্ন’। খোদাই করা বার্তা থেকে আমি উদ্ধার করলাম যে ওই সেলে অপর প্রান্তটি ঠিক মেঝে বরাবর একটি খোলা ছোট সুড়ঙ্গ রয়েছে, যেখানে দাসদের প্রস্তুত রাখা হতো। কারণ, ওপাশে জাহাজের পাটাতন তার জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিক এভাবেই দাসদের জাহাজে করে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাচার করত।
দুই...
বিদেশে চাকরি দেওয়ার কথা বলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের নৌকায় তুলে নেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে তারা নৌপথে মালয়েশিয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এজেন্টদের কথা অনুযায়ী তারা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে মালয়েশিয়ার ভূখণ্ডে পৌঁছাতে চেয়েছিল। ঠিকমতো খাবার পাচ্ছিল না যারা, তারা নৌকার মধ্যে অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে যায়। গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, ১২৩ বাংলাদেশির সন্ধান মিলেছে ওই গহিন অরণ্যে। আর একের পর এক গণকবরের সন্ধান মিলছে। থাইল্যান্ডের পুলিশের সূত্রে জানা যায়, পাচারের উদ্দেশ্যে এসব মানুষকে জঙ্গলে নিয়ে আটকে রাখা হয়। তারপর তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। বেশির ভাগেরই মৃত্যু ঘটে। তাদের স্থান হয় অগভীর গণকবরে।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় থেকেও জানা যায় যে আচেহ প্রদেশের উত্তরে সমুদ্রের মাঝ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৬৯ জন অভিবাসীকে। জেলেরা জানিয়েছে যে আচেহর উত্তরে সমুদ্রের মধ্যে একটি নৌকায় আটকে রয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। পুলিশ এসব অভিবাসীকে উদ্ধার করে; যাদের সবাই বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা এবং যার অর্ধেকই শিশু ও নারী। এই মানব পাচারের এজেন্টরা প্রথমে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের দক্ষিণে পৌঁছায়। সেখানে তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। যারা মুক্তিপণ দিতে পারে না, তাদের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু। একইভাবে থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয় মানুষকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে। তারা ছুটতে থাকে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে। পাচারের সময়ে মানুষকে গাদাগাদি করে নৌকায় কিংবা জঙ্গলে রাখা হয় এবং তাদের বিক্রি করা হয়। আলমিনা থেকে যেভাবে জাহাজে করে দাসদের নিয়ে যাওয়া হতো ইউরোপে, একইভাবে নৌকায় বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ভূখণ্ডে যেভাবে পাচার করা হচ্ছে, তা আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে।
তিন...
পোপের মর্মবাণী দিয়ে আমি শুরু করেছিলাম যে, অভিবাসন মানুষের মৌলিক অধিকার, সেটি বড় প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলমিনায় ‘ডোর অব নো রিটার্ন’ সম্পর্কে যে বিষাদময় বর্ণনা আমরা ওপরে লক্ষ করি, সেটি রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, শ্রম ও প্রবাসী—এই চারটি মন্ত্রণালয় এবং বিদেশে ব্যয়বহুল মিশনের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও নাগরিকের মর্মান্তিক অন্তর্যাত্রা আমাদের কি আলোড়িত করে না? আলমিনার শেষ সেলে যেখানে দাসদের আর পেছনে ফেরার সুযোগ থাকত না, তাদের চলে যেতে হতো জাহাজে করে পণ্য হিসেবে। দরজায় খোদাই করা উক্তিটি তাৎপর্যপূর্ণ মনে হতে পারে: ‘আমাদের পূর্বসূরিদের উদ্দেশে, যারা মৃত্যুকে বরণ করেছ; তোমরা শান্তিতে ঘুমাও, এখানে মানবতা আর কখনোই পরাজিত হবে না; এখানে অন্যায় মানবতার বিরুদ্ধে আর দাঁড়াবে না, আমরা চিরদিন তোমাদের স্মরণ করব।’
ওপরের বচনগুলো পড়তে পড়তে চোখে জল চলে আসে। আমি গেটের বাইরে চলে আসি। মাটিতে স্থাপিত একটি বড় দিগ্দর্শনযন্ত্র সচল থাকতে লক্ষ করি। লেখা আছে: ‘বিজ্ঞানের আলোকময়তা এই দিগ্দর্শনযন্ত্র’। বিজ্ঞানকে সাধুবাদ জানাই, কিন্তু এই বিজ্ঞানের আবিষ্কার যে কত মর্মস্পর্শী এবং শোষণের যন্ত্র, সেটি ঘানাসহ আফ্রিকার দাসদের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশিদের নৌপথে অভিবাসনের দিগ্দর্শন কে ঠিক করবে? অকূল সাগরে নিগৃহীত ভাসমান এই পরিচিতিহীন অভিবাসীদের দায়ভার কে নেবে? মানব পাচারকারী, রাষ্ট্র, সরকার, জাতিসংঘ কিংবা মুনাফালোভী গোষ্ঠী? আলমিনা ক্যাসলের দৃশ্যমান কম্পাস পর্তুগিজ আর ইংরেজ বেনিয়াদের দিকনির্দেশক আর মানব পাচারকারীদের দিকনির্দেশক হচ্ছে রাষ্ট্র ও তার উচ্ছিষ্টভোগীদের নয়া ঔপনিবেশিক মুনাফা, যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে অভিবাসীদের শবযাত্রা।
ড. জহির আহমেদ: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
zahmed69@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.