কালসী হত্যাকাণ্ডের ১ বছর- গ্রেপ্তার হয়নি একজনও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে by আল-আমিন

ঢাকার পল্লবীর কালসীর বিহারি পল্লীতে একই পরিবারের ৯ জনসহ ১০ জনকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় এক বছর হতে চলছে। ওই আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পল্লবী থানায় বাদী হয়ে ২টি ও বিহারীদের পক্ষ থেকে ৪টিসহ ৬টি মামলা দায়ের হয়েছিল। ঘটনার দুইদিন পর ওই মামলাগুলো তদন্তের জন্য থানা পুলিশ ডিবি পুলিশের  কাছে হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু, ডিবি পুলিশও কার্যত ওই মামলার কোন রহস্যের কিনারা করতে পারছেন না। তবে ডিবি পুলিশ বলছে, মামলাটি সংবেদনশীল হওয়ার কারণে ধীরগতিতে তদন্ত করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই ঘটনার মূল কারণ ও প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। কিন্তু, নিহতের পরিবার ও কুর্মিটোলা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই  পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত স্থানীয় ও প্রভাবশালীরা। পুলিশের ছত্রছায়াই তারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরছে। অথচ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না। শুধু তাই নয়। তারা মামলার তদন্তে পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করেন। ওই ঘটনার মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠে স্থানীয় সরকারি দলীয় এমপি ইলিয়াস আলী মোল্লার দিকে। কিন্তু, ওই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। ২০১৪ সালের ১৪ই জুন রাত সাড়ে ৩টায় গভীর রাতে শবেবরাতের রাতে আতশবাজিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর পল্লবীর কালসীতে বিহারীদের সঙ্গে পুলিশ ও স্থানীয় জনতার সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ দুপুর সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলতে থাকে। এতে দুর্বৃত্তরা কালসীর রাস্তার ধারে কয়েকটি ঘরে তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে একটি ঘরে আটকা পড়ে একই পরিবারের ৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন। আর রাতের বেলায় পুলিশের গুলিতে স্থানীয় এক যুবক নিহত হন। নিহতরা হলেন, নিহতরা হলেন- সাহানী বেগম (২৩), তার ছেলে মারুফ (৩), তার মা বেবি (৪০), সাহানির বোন আফসানা (২২)।  অপর একটি পরিবারের নিহত সদস্যরা হচ্ছেন রুচি (১০), রুচির ভাই আশিক (২২) এবং আশিকের স্ত্রী শিখা (১৯)। লালু (১১) ও ভুলু (১১) নামের দুই যমজ ভাইও ছিল। এ ছাড়াও আজাদ (৩৫) নামে একজন অবাঙালি যুবকও নিহতের তালিকায় ছিল। এ ঘটনায় প্রায় উভয় পক্ষের প্রায় ৫০ জন আহত হন। সূত্র জানায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার স্থাপিত রাজু বস্তিতে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে বিদ্যুৎ  লাইনের সংযোগ স্থাপন নিয়ে আগে থেকেই স্থানীয়দের সঙ্গে বিহারীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। ওই দ্বন্দ্বের জেরে এ ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। ওই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্থানীয় ও বিহারীসহ ৭ জনকে পুলিশ আটক করেছিল। পুলিশ তাদের দুইদিনের রিমান্ডেও নেয়। কিন্তু, তাদের কাছে কোন তথ্য না পাওয়া যাওয়ায় তাদের কারাগারে পাঠায় আদালত। তারা সবাই কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে এসেছেন। এ ঘটনার পরের দিন পল্লবী থানায় ৬টি মামলা করা হয়। স্থানীয় ও ক্ষতিগ্রস্তরা বাদী হয়ে ৪টি মামলা করেন। তাদের মামলা নম্বর- ২৭ থেকে ৩০। পুলিশ বাদী হয়ে ২টি মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩১ ও ৩২। ওই ৬টি মামলা থানা পুলিশের পক্ষ থেকে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা গ্রহণ করেন ওই সময়ের ডিবি পশ্চিমের ডিসি শেখ নাজমুল আলম। পল্লবী থানার ওসি দাদন ফকির জানান, ঘটনার দুইদিন পরেই মামলাগুলো ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা বিষয়টি এখন তদন্ত করছে। ওই মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এডিসি (পশ্চিম) সাইফুল ইসলাম জানান, কালসীর ঘটনার প্রায় ১ বছর হয়ে আসছে। ওই ঘটনার মামলার দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। কেউ গ্রেপ্তারও নেই। তিনি আরও জানান, ঘটনার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। খুব শিগগিরই ওই হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন ও খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।  তবে মামলা তদন্তের সঙ্গে জড়িত এক ডিবি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বিদ্যুৎ লাইনের সংক্রান্তের বিরোধ এবং বিহারীদের মধ্যে তীব্র পুলিশ বিদ্বেষী মনোভাবের কারণেই ওই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রাজু বস্তির লোকজন কুর্মিটোলা ক্যাম্প থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়ার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু, এতে বাধা প্রদান করেন কুর্মিটোলার বাসিন্দারা। ঘটনার আগের ১১ই জুন রাতে বিহারীদের সঙ্গে রাজু বস্তির লোকজনের কথা কাটাকাটি হয়। ওই বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ডিবি পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন। গতকাল সকালে সরজমিনে কুর্মিটোলা বিহারী ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ওই লোমহর্ষক ঘটনায় এখন বিক্ষুব্ধ স্থানীয় ও ক্ষতিগ্রস্তরা। তারা হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করেছেন। নিহত সাহানি বেগমের চাচাতো বোন আসমা বেগম বলেন, দুর্বৃত্তদের আগুনে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের হারিয়েছে। যারা ওই হামলার সঙ্গে জড়িত তারা কেউ এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। কারা সেদিন ওই নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে সব পুলিশ জানে। কিন্তু, পুলিশ তাদের  গ্রেপ্তার করছে না। নিহত আজাদের বন্ধু আসলাম হোসেন জানান, ওই ঘটনার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ছিল স্থানীয় এমপির। হামলার সঙ্গে জড়িত তারা সবাই এমপির লোক। পুলিশ তাদের ধরছে না। এ বিষয়ে বিহারীদের সংগঠন উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহ্যাবিলিট্যাশন মুভমেন্টের সভাপতি সাদাকাত হোসেন খান জানান, ঘটনার পর পুলিশ দাবি করেছিল ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও খুনিদের গ্রেপ্তার করার জন্য। কিন্তু, ১ বছর হয়ে যাচ্ছে কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, হামলার সময় আমাদের লোকজন স্টিল ক্যামেরায় কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করেছিল। ওই ফুটেজগুলো পুলিশকে আমরা দিয়েছিলাম। ওই ফুটেজে স্পট দেখা যাচ্ছে যে, হামলায় পুলিশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উস্কানি আছে। এখন যদি ওই মামলায় পুলিশ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে তাহলে পল্লবী জোনের কিছু ঊর্ধ্বতন পুলিশের কর্মকর্তারা ওই হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারবেন না। এজন্য পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করছে না। উর্দুভাষী ছাত্র আন্দোলনের সেক্রেটারি ইমরান আহমেদ বলেন, কার কাছে বিচার চাইবো? হামলার সঙ্গে তো পুলিশ নিজেই জড়িত। এদিকে, ওই ঘটনার ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয়দের সমঝোতায় আনতে স্থানীয় সরকারদলীয় এমপি ইলিয়াস উদ্দীন মোল্লা একাধিক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয়রা তাতে রাজি হননি। তারা ওই ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.