সন্তানকে আইসিইউতে রেখে বারে যান এমপিপুত্র রনি

৪০ দিন বয়সী শিশু সন্তান হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। আর বাবা এমপিপুত্র বখতিয়ার আলম রনি রাতভর সময় কাটাতেন রাজধানীর বিভিন্ন বারে। মধ্যরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরতেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে এসব কথা নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন তিনি। মদ্যপ অবস্থায় নিউ ইস্কাটন রোডে দুই নিরীহ রিকশা ও সিএনজি চালককে গুলি করে হত্যার পরও এনিয়ে কোন অনুশোচনাও ছিল না তার। নিজের মুখেই জানান, গুলির ঘটনার দুদিনের মাথায় তার সেই নবজাতক সন্তান মারা যায়। তারপরও মদের নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। প্রায় প্রত্যেক রাতেই গভীর রাত পর্যন্ত বারে বসে সময় কাটাতেন। জোড়া খুনের ঘটনায় রনিকে গ্রেপ্তারের পর ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। রনির নিজ মুখে এমন বিবরণ শুনে রীতিমতো থ’ বনে গিয়েছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও।
গত ১৩ই এপ্রিল রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে একটি কালো প্রাডো গাড়ি থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েন মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের এমপি পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি। তার গুলিতে দৈনিক জনকণ্ঠের অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী ও রিকশাচালক আবদুল হাকিম নিহত হন। এ ঘটনায় নিহত হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে ১৫ই এপ্রিল রাতে অজ্ঞাতদের আসামি করে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে তদন্তভার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে স্থানান্তর করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রথমে রনির গাড়িচালক ইমরান ফকির ও পরে রনিকে গ্রেপ্তার করে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গতকাল ৪ দিনের রিমান্ড শেষে রনিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়ার চেষ্টা করা হলেও সে তা দেয়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রনি মাদকাসক্ত হলেও ধূর্ত প্রকৃতির। এ কারণে সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়নি। তবে এতে কোন সমস্যা হবে না। পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় সবকিছু স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে তার লাইসেন্সকৃত পিস্তল ও গুলির সঙ্গে নিহত দুই জনের শরীর থেকে উদ্ধার করা গুলির ব্যালাস্টিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। রনির ব্যবহৃত প্রাডো গাড়িটি জব্দ করার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া, বস্তুগত আরও অনেক প্রমাণ রয়েছে। রনির পার পাওয়ার কোন উপায় নেই।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১০ সালে রনি তার নামে একটি পিস্তলের লাইসেন্সের আবেদন করেন। মা আওয়ামী লীগ নেতা বলে তদবির করে সহজেই পিস্তলের লাইসেন্স পেয়ে যান। তাকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে ২১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। তবে তার কাছ থেকে যে গুলির খাপ উদ্ধার করা হয়েছে তাতে ৩০ রাউন্ড গুলি ধরতো। ইস্কাটনের ঘটনায় তিনি ৪ থেকে ৫ রাউন্ড গুলি করেছিলেন। বাকি গুলি কী কাজে ব্যবহৃত হয়েছে তা অবশ্য তিনি এড়িয়ে গেছেন। গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে তার পিস্তলের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশসহ জেলা প্রশাসকের কাছে তাকে বরাদ্দ দেয়া গুলির বিষয়টি জানতে চিঠি দেয়া হয়েছে।
রনিকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার দিন রনি তার তিন বন্ধুকে নিয়ে বাংলামোটরের একটি বারে মদ্যপান করে। পরে বাংলামোটর থেকে মগবাজারে এক বন্ধুকে নামিয়ে দেয়ার জন্য যায়। ফ্লাইওভারের কাজের জন্য একপাশের রাস্তা বন্ধ থাকায় বামের লেনে জট লেগে যায়। সেসময় কয়েকটি বালুর ট্রাকও রাস্তায় ছিল। রাস্তায় এই যানজটের কারণে বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকেই এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে রনি। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তা ফাঁকা হলে সে মগবাজার চলে যায়। পরে আবার একই রাস্তায় ফিরে যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনাটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা জনকণ্ঠ ভবনের লাগানো সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেন। সেই সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় কালো একটি প্রাডো গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে। প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানায়, কালো গাড়ি থেকে গুলি করা হয়েছিল। পরে গাড়ির সূত্র ধরেই গাড়িচালককে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক দীপক কুমার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রনিকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে আদালত সূত্র জানায়, রনিকে গতকাল আদালতে হাজির করা হলে তার পক্ষে জামিন ও চিকিৎসার পৃথক দুটি আবেদন করা হয়। রনির পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ। মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূর আগামী ১৬ই জুন শুনানির দিন ধার্য করে রনিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে জেল বিধি অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।

No comments

Powered by Blogger.