সাড়ে তিন লাখ টাকায় পিএইচডি ডিগ্রি by নূর মোহাম্মদ

মাত্র সাড়ে ৩ লাখ টাকায় পিএইচডি ডিগ্রি। তাও কোন দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি নয়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। খোদ রাজধানীর ঢাকায় বসে আমেরিকার পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছেন ‘আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতি না থাকলেও নামে-বেনামে এসব ডিগ্রি দিচ্ছেন তারা। আমেরিকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশ স্টাডি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলে এমফিল, পিএইচডি, অনার্স, মাস্টার্সসহ ৭ ধরনের ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে। আর এসব ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা পেশা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করছেন অনেকেই। দীর্ঘ দিন ধরে এই ভুয়া ডিগ্রি দিয়ে সরকার থেকে অতিরিক্ত সুবিধাও নিচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি ওই প্রতিবেদক পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানে ফোন করেন। প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ অফিসার (কাউন্সিলিং) ফোনে জানান, ভর্তি বিষয়ে ফোনে কথা না বলে সরাসরি কথা বলা ভাল। বিশেষ ছাড় চলছে বলেও জানানো হয়। তার দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী রাজধানী বিজয়নগর মোড়ে নাভানা রহিম আর্ডেনের ১০তলা গেলে কয়েকটি প্রসপেক্টাস দিয়ে ভর্তির বিস্তারিত বুঝিয়ে দেন। বলেন, স্যার পিএইচডি নেয়ার উপযুক্ত সময় এখন। আপনার বয়স ও সময় দুটিই আছে। এরপর ভর্তি নির্দেশিকা দেখান। সেখানে এমফিল ডিগ্রির জন্য ৩৫০০ ডলার, পিএইচডি ডিগ্রি জন্য ৭৫০০ ডলার, পোস্ট ডক্টরেট জন্য ৪৫০০ ডলার, ব্যাচেল ডিগ্রির জন্য ৪৫০০ ডলার এবং মাস্টার্সের জন্য ২৫০০ ডলার ব্যয়ের তালিকা দেয়া। তবে আপনি যদি এখন ভর্তি হতে চান, তবে বিশেষ ছাড় দেয়া হবে। কত ছাড় দিবেন জানতে চাইতে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা চেয়ারম্যান স্যার নির্ধারণ করে দেন। আপনার আগ্রহ ও রেজাল্টের উপর মূলত ছাড় নির্ধারণ হয়ে থাকে। তবে আপনি সাড়ে ৩ লাখ টাকায় পিএইডডি ডিগ্রি নিতে পারবেন। ভর্তির সময় ১ লাখ ২০ হাজার। বাকি ২০টি কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। কোর্স সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম চার মাস কোর্সের উপর ক্লাস করতে হবে। প্রতি শুত্রুবার এখানে ক্লাস হয়। পরবর্তীতে আপনার পছন্দের বিষয়ের উপর একটা থিসিস জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সুপারভাইজার আপনাকে সর্বাত্মক সাহায্য করবেন। থিসিস জমা দিলে এটা আমরা আমেরিকা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দেব। আপনার থিসিস গ্রহণ হলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি আপনার সার্টিফিকেট ইস্যু করবে। আমরা শুধু এখানে তাদের হয়ে কাজ করি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে আমেরিকা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ব্যবহার করে ৩০ কাকরাইল থেকে এরকম এমফিল, পিএইডডি ডিগ্রি দেয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠানটি মালিক সেলিম ভূঁইয়ার নামে মামলা করে তাকে গ্রেপ্তার করান। জামিনে বের হয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম বদল করে ‘সেড ইন্টারন্যাশনাল’ ও ঠিকানা পরিবর্তন করে বিজয় নগর নতুন অফিসে নিয়ে ফের এ কাজ শুরু করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউজিসির সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি (লিগ্যাল) মৌলি আজাদ মানবজমিনকে বলেন, ইউজিসির অনুমোদন না থাকার পর এই প্রতিষ্ঠানটি এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি বিক্রির জন্য তার বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছিলাম। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটিতে বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন কোন প্রতিষ্ঠান থাকলে সেটি আমাদের জানা নেই। ২০১০ সালের জুলাই মাসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন বলা আছে, অনুমোদনপ্রাপ্ত নয়, কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশে কোন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা, ক্যাম্পাস, স্ট্যাডি সেন্টার বা টিউটোরিয়াল সেন্টার ইত্যাদিতে শিক্ষার্থী ভর্তি বা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। অর্থাৎ কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদেশের কোন স্ট্যাডি সেন্টারের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি দেয়া হয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সিইও সেলিম ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ডিসটেন্স লানিং যদি অবৈধ হয়, তাহলে এটা সকলের জন্য অবৈধ। যারা বাংলাদেশে এ লেভেল, ও লেভেল, ভূঁইয়া একাডেমি বিভিন্ন কোর্স, ব্যারিস্টার কোর্স, এডেক্সেল, এসিসিএ, সিএ সবাই কিন্তু বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিচ্ছেন। সেটা যদি বৈধ হয় তবে এমফিল, পিএইচডি কেন বৈধ নয়। সবগুলোই ডিসটেন্স লানিং লেভেলের মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৩৯ ধারায় এ বিষয়টি স্পষ্ট বলা আছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই আইন না মেনে একঘেঁষা একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। তার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বলেন, আমি এখানে চাকরি করি। আমেরিকা ও লন্ডনের প্রতিষ্ঠানের তথ্য সেন্টার হিসেবে আমি কাজ করি। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি আমার কোন বক্তব্য নেই।
শিক্ষামন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সম্প্রতি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয় মন্ত্রণালয়কে। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পিএইচডি ডিগ্রি আছে এই শর্তে দ্রুত পদোন্নতি চান। সেখানে তারা তাদের ডিগ্রি দাখিল করেন। মন্ত্রণালয় দাখিলকৃত সার্টিফিকেট যাচাই-বাছাই করে দেখেন দাখিলকৃত ডিগ্রির বেশিরভাগ অনুমোদিতহীন প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া। এরমধ্যে বেশিরভাগ ডিগ্রিই বন্ধ হওয়ায় আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে নেয়া। এরপর মন্ত্রণালয়, একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে বলা হয়, কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণের মাধ্যমে নেয়া পিএইচডি ডিগ্রির বৈধতা নেই। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সর্বসাধারণের অবগতির জন্য এ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি দেয়নি। এ ছাড়া কোন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলা বা কোন দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদনও দেয়া হয়নি। এরপরও কীভাবে পিএইচডি ডিগ্রি দেন জানতে চাইলে সেলিম ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এ ধরনের কোন কথা উল্লেখ ছিল না।
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, দেশে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, শিক্ষকসহ  বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু লোক বিশেষ সুবিধা নিতে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে থাকেন। তারা অনায়াসে নামের আগে ্তুডক্টর্থ শব্দটি ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থানীয় কমিটি অবৈধ ডিগ্রিধারীদের ধরতে একটি কমিটি গঠন করেছে। বিশেষ করে যারা অবৈধ পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে নানা সরকারী আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন দ্রুত তাদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আফসারুল আমিন বলেন, আপনাদের পত্রিকায় একটি রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা জানতে পারি প্রায় ৫ হাজার ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি আছে। এরপরই কমিটি গঠন করেছি। বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার বৈঠকও হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সাবেক সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান মানবজমিনকে বলেন, পিএইচডি হচ্ছে একটা গবেষণা। একজন গবেষককে একটি তত্ত্বের আলোকে একটা নতুন গবেষণা উপস্থাপন করতে হয়। এটা একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা। নতুন একটি তথ্য তিনি গবেষণা করে উপস্থাপন করবেন। কিন্তু আমাদের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা তা কী করছেন? কোথায় তাদের গবেষণা? কী তার কোয়ালিটি?  কে তাদের তত্ত্বাবধায়ক? কীভাবে তারা গবেষণা করছেন? এসব  দেখার  কেউ নেই। মজার কথা হলো যার নিজেরই পিএইচডি নেই, অধ্যাপকও নন- তারাও এখন পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.