থাই পেয়ারায় ভবিষ্যতের ঠাঁই by আজাদ রহমান

নিজের পেয়ারা খেতে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার কাছে পরামর্শ
নিচ্ছেন সুকুমার সরকার (বাঁয়ে) l ছবি: প্রথম আলো
জন্মের পরই মা দেখলেন ছেলেটির বাঁ হাতে কোনো আঙুল নেই। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন মা ভাবলেন, কী করে খাবে ছেলেটি! ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট এই ছেলেটি সংসারে অন্যদের সঙ্গে বড় হতে থাকল। এই ছেলেটিই যে একদিন নিজের গ্রামের মানুষের জীবনচিত্র পাল্টে দেবে, তা ভাবেননি কেউ-ই।
সুকুমার সরকার (৩৮)। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। সুকুমারের কল্যাণেই গ্রামটি এখন ‘পেয়ারা গ্রাম’ নামে পরিচিত। সুকুমারের হাত ধরে শুরু হওয়া থাই পেয়ারার চাষ চলছে গ্রামটির এক হাজার বিঘা জমিতে। সচ্ছল হচ্ছে মানুষ, আর পেয়ারার চাষ ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রামগুলোতে।
কোটচাঁদপুর উপজেলা সদর থেকে নয় কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার পর সাব্দালপুর বাজারসংলগ্ন গ্রামটিই শ্রীরামপুর। প্রায় ৩০০ পরিবার এখানে বাস করে। গ্রামটির প্রধান সড়কটি পাকা, পাড়া-মহল্লার রাস্তাগুলো আধা পাকা। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষিত হলেও নানা কারণে অসচ্ছল। সুকুমারের বাবা মৃত সুধীর কুমার সরকার ছিলেন স্বর্ণকার।
মা নিভারানী সরকার প্রথম আলোকে জানান, সুকুমারের জন্মের পর দেখলেন বাঁ হাতের আঙুলগুলো নেই। চিন্তা হতো, বড় হয়ে কী করবে। বড় হওয়ার পরও অনেক কাজই ছেলেকে করে দিতেন তিনি। মা জানালেন, ‘ও পড়াশোনা করল। এসএসসি পাস করল। কিন্তু পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা আর এগোয়নি। পরে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে শুরু করল চাকরি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে পেয়ারার চাষ ধরল।’ এখন এই ছেলের কথা ভেবে কেমন লাগে? মায়ের জবাব, ‘গ্রামের সবাই তাকে ভালো বলে, সবাই পছন্দ করে—এটাই খুব ভালো লাগে।’ গ্রামের জন্য, গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আত্মতৃপ্তি আছে সুকুমারেরও।
২০০৮ সালে কোনো এক কাজে পিরোজপুর জেলার আটঘর-কুড়িয়ানা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন সুকুমার। সেখানে গিয়ে মাঠের পর মাঠ পেয়ারা আর আমড়ার চাষ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। কথা বলেন, ওই গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। সবকিছু শুনে পেয়ারা চাষের বিষয়টি তাঁর মনে ধরে। সিদ্ধান্ত নেন, তিনিও পেয়ারার চাষ করবেন।
সুকুমার জানালেন, শুরুতে চারা বা কলম পাচ্ছিলেন না তিনি। পরে পেয়ারাচাষিদের অনেক বলে-কয়ে ৫৬টি কলম পেলেন। সেগুলো ৩০ শতক জমিতে লাগালেন। মাত্র সাড়ে চার মাস পর পেয়ারা ধরতে শুরু করে। দারুণ এক অনুভূতি হয় সুকুমারের মনে। সেবারই ৪৫ হাজার টাকার পেয়ারা বিক্রি করেন তিনি। পরের বছর পেয়ারা চাষ করলেন দুই বিঘা জমিতে। এবার আয় হলো ২ লাখ ২০ হাজার টাকার।
আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ক্রমেই চাষ বাড়িয়েছেন। জমি কিনেছেন। বর্গাও নিয়েছেন কিছু জমি। বর্তমানে তাঁর ১১ বিঘা জমিতে পেয়ারার চাষ রয়েছে। পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী সাধনা সরকার ও একমাত্র পুত্র সুচয় সরকারকে নিয়ে স্বচ্ছন্দেই চলছে সুকুমারের সংসার।
যেভাবে ছড়িয়েছে পেয়ারার চাষ: সুকুমারই তাঁদের এলাকায় পেয়ারার চাষ শুরু করেন। পরে অন্যদেরও পেয়ারা চাষের জন্য উৎসাহ দেন, জানালেন শ্রীরামপুর গ্রামের জিল্লুর রহমান। এখন গ্রামের অনেক কৃষক এই চাষ করছেন। পেয়ারা চাষে কৃষকদের এই আগ্রহের কারণও তুলে ধরলেন জিল্লুর, ‘আগে এই গ্রামে ধান, পাট, কলা, ছোলা-মসুরি, আখের চাষ হতো। কিন্তু চাষের খরচ বাদে কৃষকদের তেমন লাভ থাকত না।’ উদাহরণ দিয়ে জিল্লুর দেখালেন, যেখানে এক বিঘা জমিতে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ করে ধান চাষের পর তাঁরা পান ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সেখানে বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা খরচ করে পেয়ারা চাষ করে তাঁরা পাচ্ছেন দুই লাখ টাকার মতো।
এখন এই জিল্লুর ছাড়াও আবদুর রহিম, কাজী জালাল উদ্দিন, আসলাম হোসেন, ছবদুল হোসেন, মিলন বিশ্বাস, মনির উদ্দিনসহ অন্তত ১২৫ জন কৃষক পেয়ারার চাষ করছেন। এই চাষ ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের দোড়া, সাব্দালপুর, পাঁচলিয়া, কুশনাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে মাঠের পর মাঠ পেয়ারার খেত। সবই থাই পেয়ারা। কৃষক আসলাম হোসেন জানান, চার বছর আগেও কৃষিশ্রমিক ছিলেন। সংসারে অভাব ছিল। পেয়ারা চাষ করে এখন বেশ সচ্ছল। বর্তমানে তাঁর চার বিঘা জমিতে পেয়ারার চাষ রয়েছে। পাকা বাড়ি করেছেন। দুই বিঘা জমিও কিনেছেন। কৃষক মিলন বিশ্বাস দুই বিঘা জমিতে পেয়ারার চাষ করেছেন। তিনি জানালেন, বছরে বিঘায় দেড় লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেন।
আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পেয়ারা চাষে পরিশ্রম তুলনামূলক কম। আবার অন্য ফসলের মতো বিক্রি করতে বাজারে যেতে হয় না। পাইকারেরা এসে পেয়ারা কিনে নিয়ে যান। উৎপাদন ভালো হলে কেজিপ্রতি পেয়ারা ৩০ থেকে ৪০ টাকায় এবং উৎপাদন কিছুটা কম হলে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়।
চাষ হয় যেভাবে: প্রথমে জমি চাষ করে সারিবদ্ধভাবে গর্ত করে নিতে হয়। গর্তের মাটির সঙ্গে জৈব সার মিশিয়ে ১৫ দিন রাখা হয়। এরপর কলম রোপণ করা হয়। চার থেকে সাড়ে চার মাসের মধ্যে পেয়ারা ধরতে শুরু করে। দেড় মাস গাছে থাকলেই পেয়ারা বিক্রির উপযুক্ত হয়।
কৃষক মনির উদ্দিন জানালেন, পেয়ারা চাষে গাছের পরিচর্যা, জমিতে আগাছা পরিষ্কার আর মাঝেমধ্যে পোকার আক্রমণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হয়। কৃষি বিভাগের দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের আওতায় পেয়ারা চাষে কৃষকেরা বেশ কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানালেন সুকুমার। কোটচাঁদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাজী সাজ্জাদ হোসেন জানান, ২০১২ সাল থেকে তাঁরা শ্রীরামপুরের কৃষকদের সহযোগিতা করছেন। শ্রীরামপুর গ্রামে প্রায় এক হাজার বিঘা ও আশপাশের গ্রামগুলোতে ১১২ বিঘা জমিতে পেয়ারার চাষ চলছে।
গ্রামের ‘আদর্শ মিতালী পাঠাগার’-এর সভাপতি কাজী তমাল জানান, সুকুমার সরকারের মাধ্যমে পেয়ারা চাষ এসেছে তাঁদের গ্রামে। এই চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। প্রায় ১২ বছরের অচল থাকা এই পাঠাগারটি পেয়ারাচাষিদের সহযোগিতায় আবার সচল হয়েছে। দুই বছর আগে পাকা ঘর হয়েছে। নতুন করে বেশ কিছু বই সংগ্রহ করা হয়েছে।
দোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বিশ্বাস জানান, তাঁর ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছে পেয়ারার চাষ। সুকুমার সরকারের মাধ্যমেই গ্রামটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.