মানব পাচার- হাজেরা, সুফিয়াদের কান্না থামছে না by আব্দুল কুদ্দুস

মানব পাচারকারীদের কবলে পড়ে নিখোঁজ ছেলে হারুন
অর রশিদের ছবি হাতে মা হাজেরা খাতুন l প্রথম আলো
কক্সবাজারের রামু উপজেলার দুর্গম দারিয়ারদীিঘ গ্রাম। গ্রামের একেবারে দক্ষিণে দিনমজুর আবদুল শুক্কুরের মািটর ঘর। ঘরের দাওয়ায় বসে বিলাপ করে চলেছেন শুক্কুরের স্ত্রী হাজেরা খাতুন। হাতে বড় ছেলে হারুন অর রশিদের (১২) দুটি ছবি। আড়াই বছর আগে তাকে অপহরণ করে থাইল্যান্ডে পাচার করে দালালেরা। সেই থেকে হারুন নিখোঁজ।
হারুন তখন পড়ত দক্ষিণ দারিয়ারদীঘি সরকাির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে সংসারের অভাব ঘোচাবে। কিন্তু এখন সবকিছুই ফিকে হয়ে গেছে।
৫ মে রামুর দারিয়ারদীঘি গ্রামে গেলে কথা হয় আবদুল শুক্কুর ও হাজেরা খাতুনের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেন হাজেরা—‘থাইল্যান্ডের জঙ্গলে যে গণকবর পাওয়া গেছে, সেখানে আমার হারুন নাই তো? আপনারা দালালদের বিরুদ্ধে লেখেন না কেন? আমার হারুন কবে ফিরে আসবে?’ এরপর আবার বিলাপ করতে থাকেন।
এ সময় মায়ের পাশে থাকা হারুনের ছোট দুই ভাইও কান্না জুড়ে দেয়।
আবদুল শুক্কুর জানান, আড়াই বছর আগে স্থানীয় দালাল দানু মিয়া হারুনসহ কয়েকজনকে জোর করে ট্রলারে তুলে থাইল্যান্ডে পাচার করে। ছেলের সন্ধান চাইলে দালাল দানু উল্টো প্রাণনাশের হুমকি দেয়। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর দানু আত্মগোপন করে।
একটু দূরে আরেক দিনমজুর সোনা আলীর বাড়ি। সেখানেও একই চিত্র। সোনা আলীর স্ত্রী সুফিয়া খাতুন নিখোঁজ ছেলে ফরিদ মিয়ার জন্য কান্নাকাটি করছেন। এক বছর আগে দালালচক্র ফরিদ মিয়াকে (১২) অপহরণ করে থাইল্যান্ড পাচার করে। সেও দক্ষিণ দারিয়ারদীঘি সরকাির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
সোনা আলী বলেন, ‘ধরে নিয়েছিলাম ফরিদ আর ফিরে আসবে না। কিন্তু সম্প্রতি থাইল্যান্ড সীমান্তের গহিন জঙ্গলে একাধিক গণকবরের সন্ধান পাওয়া এবং তাতে বাংলাদেশি অনেকের লাশ পাওয়ার খবরে মনের মধ্যে নতুন করে অশান্তি দেখা দিয়েছে। ছেলের জন্য সারাক্ষণ মনটা ছটফট করছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এই দারিয়ারদীঘি গ্রাম থেকেই গত আড়াই বছরে চার শতাধিক মানুষ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া পাচার হয়েছে। এর মধ্যে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে অন্তত ২৭ জন।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইকুল আহমদ ভূঁইয়া জানান, দারিয়ারদীিঘর মানবপাচারকারী মোস্তাক আহমদকে ৬ মে সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তার কাছ থেকে ৯ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়। মানবপাচারের পাশাপাশি মোস্তাক ইয়াবা পাচারেও জড়িত। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। ওসি জানান, দুর্গম গ্রামে অপহরণের ঘটনা ঘটলেও কেউ থানায় অভিযোগ করে না। ফলে পুলিশের অপরাধী ধরতে বেগ পেতে হয়।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, দারিয়ারদীিঘর মতো টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া, কাটাবুনিয়া, সাবরাং, বাহারছড়া, জাদিমুরা, ইসলামাবাদ, হোয়াইক্যং, কক্সবাজারের দরিয়ানগর, নাজিরারটেক, নুনিয়াছটাসহ বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবরে উপকূলের নিখোঁজ ব্যক্তিদের ঘরে ঘরে আহাজারি চলছে।
পুলিশের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৪১ দালালের নিয়ন্ত্রণে চলছে কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানবপাচার। ২৪১ দালালের চার স্তরের সহযোগী রয়েছে আরও আড়াই লাখ ব্যক্তি। এদের কেউ মানবপাচারে অর্থলগ্নিকারী, কেউ মানব সংগ্রকারী। আবার কেউ উপকূলে ট্রলারে তুলে দেওয়া ও থাইল্যান্ড সীমান্তে পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যাত্রীসহ সহযোগীরা ধরা পড়লেও মূলহোতারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ জানান, গত দুই মাসে পুলিশ উপকূলে অভিযান চালিয়ে তিন শতাধিক মালয়েশিয়াগামী যাত্রীসহ ২০ জন দালালকে গ্রেপ্তার করেছে। মানবপাচার ঠেকাতে সারা দেশে পুলিশের বিশেষ অভিযান চলছে।

No comments

Powered by Blogger.